বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুদকের অভিযান / ছবি- সংগৃহীত

অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দল। বিষয়টি বরিশালসহ সারাদেশে বেশ আলোচিত হয়। দুদকের ওই অভিযানের বিরুদ্ধে আন্দোলন, পরবর্তীতে স্মারকলিপি পর্যন্ত দেন চিকিৎসকরা।

দুদকের অভিযানের পর আর কোনো আইনি ব্যবস্থার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় দুদক টিমের আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান, মামলা কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযানের ছয় মাস পার হলেও এ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড ফাইলচাপা অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে

অথচ, অভিযানকালে কর্তব্যরত অধিকাংশ চিকিৎসককে হাসপাতালে পায়নি দুদক টিম। সেবার মান, ওষুধ ক্রয় ও নিয়োগ সংক্রান্ত অনেক অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতাও মেলে। কিন্তু বিতর্কের সূত্রপাত হয় যখন চিকিৎসকদের বায়োমেট্রিক হাজিরা রেকর্ড দুদক টিম দেখতে চায়। এরপরই দুদকের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ।

যদিও দুদকের অভিযানের পর আর কোনো আইনি ব্যবস্থার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় দুদক টিমের আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান, মামলা কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযানের ছয় মাস পার হলেও এ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড ফাইলচাপা অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযানের বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম। পরবর্তী আপডেট আমার জানা নেই।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল / ছবি- সংগৃহীত

২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযানের দায়িত্ব পালন করেন দুদকের সহকারী পরিচালক রাজ কুমার সাহার নেতৃত্বে একটি টিম। এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমাদের অভিযান পরিচালনার পর যা পেয়েছি, তা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।

অন্যদিকে, দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অভিযান পরিচালনার পর আমরা প্রতিবেদন পেয়েছি। যাচাই-বাছাই শেষে কমিশনের অনুমতিক্রমে আইন অনুযায়ী দুদক অবশ্যই পদক্ষেপ নেবে।

দুদকের অনুসন্ধানে যা উঠে এসেছে

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় মেডিসিন ও নিউরোলজি বিভাগের ইউনিট- ২ বিভাগে উপস্থিত হয়। এ সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. আনোয়ার হোসেন বাবলু ও সহযোগী অধ্যাপকসহ অন্যান্য চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে সময় তাদের কক্ষ তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। অভিযানকালে হাসপাতালের মেডিসিন, অর্থোপেডিক বিভাগের দু-একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক ব্যতীত অন্য কোনো চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। ওই সময় হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. মো. মনিরুজ্জামান শাহীনের অফিস কক্ষে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। টিম ১৪ চিকিৎসকের হাজিরা খাতা ও বায়োমেট্রিক হাজিরায় স্বাক্ষর সংগ্রহ করে। যারা প্রত্যেকে ৯টার পর আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা দেরি করে অফিসে আসেন। ওই সময় ডা. মাসুম আহমেদসহ অনেকেই রূঢ় আচরণ করেন।

আরও পড়ুন >> ঘটনা সত্য, তারপরও তারা ‘দায়মুক্ত’! 

অভিযানকালে অধ্যক্ষ ডা. মনিরুজ্জামান শাহীনকে মোবাইল ফোনে অভিযোগের বিষয়টি অবগত করলে তিনি সকাল সাড়ে ৯টায় নিজ চেম্বারে আসেন। এ সময় বায়োমেট্রিক হাজিরাসহ বিভিন্ন নথিপত্র চাইলে তা দিতে অস্বীকার করেন তিনি। অভিযানের প্রমাণস্বরূপ স্থিরচিত্র ধারণ করতে গেলে তিনি বাধা দেন এবং টিমের সদস্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। যা দুদক আইনকে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের শামিল। টিমের সদস্যদের হুমকি-ধমকি দিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এমনকি অভিযানের শেষ পর্যায়ে ডা. আনোয়ার হোসেন বাবলু ও নিউরোমেডিসিন বিভাগের ডা. অমিতাভ সরকারকে নিজ কক্ষ, ক্লাস রুম এমনকি ওয়ার্ডেও পাওয়া যায়নি। ওই সময় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের উপস্থিতির সময় ছিল সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অভিযানকালে বিভিন্ন মানুষের বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে যে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মনিরুজ্জামান শাহীনের নামে ঢাকার পরীবাগে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ঢাকায় নিজ ও স্ত্রীর নামে একাধিক প্লট এবং ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে অফিস সরঞ্জাম ক্রয় না করে সরকারি অর্থ আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন >> পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির ৫ কারণ, ব্যবস্থা চায় দুদক

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুদকের অভিযান / ছবি- সংগৃহীত

গত দুই বছর ধরে বছরভিত্তিক চুক্তিতে ১০০ জন করে নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী অনুমোদনবিহীন মাস্টার রোল দেখিয়ে প্রতি মাসে ১১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১২ হাজার ৫০০ টাকা হারে বেতন উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন ওই অধ্যক্ষ। এর বাইরে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন তিনি।

দুদকের অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ও নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আনোয়ার হোসেন বাবলু হাসপাতালের রোগীদের ভালোভাবে চিকিৎসাসেবা না দিয়ে বরিশালের মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লি., পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবএইড হাসপাতালে গভীর রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন। অকারণে রোগীদের তার মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টার হতে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলেন। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন গ্রহণ করেন তিনি।

এছাড়া নিউরোমেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. অমিতাভ সরকার হাসপাতালের রোগীদের ভালোভাবে চিকিৎসাসেবা না দিয়ে বরিশালের কেএমসি হাসপাতাল, বেলভিউ মেডিকেল প্রাইভেট সার্ভিসেস লি., রাহাত আনোয়ার হাসপাতাল ও কণিকা ডায়াগনস্টিক হাসপাতালে ভোররাত পর্যন্ত রোগী দেখেন। অন্যদিকে, ডা. সুদীপ হালদারের বরগুনা সদর হাসপাতালে পোস্টিং হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেখানে দায়িত্বপালন না করে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সিন্ডিকেট তৈরি করে বিভিন্ন প্রকার অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছেন।

যদিও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যক্ষ ডা. মো. মনিরুজ্জামান। ‘আমরা দুর্নীতি করি না, আমার সব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতিমুক্ত’— এমন দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অফিসের সামনে এটা লিখিতভাবে টানানো আছে। আমাদের ঘোষণা হলো, আমরা দুর্নীতি করি না। আমরা যেহেতু ঘোষণা দিয়েছি, অবশ্যই আমাদের মানতে হবে। আমাদের চিকিৎসক বা কর্মচারীরা বাইরের ডায়াগনস্টিক বা হাসপাতালে প্র্যাকটিস করতে পারেন কিন্তু এ ব্যবসার সঙ্গে তারা জড়িত— এমন অভিযোগ আমি পাইনি। এমনকি কোনো সংস্থা থেকেও এ ধরনের অভিযোগ দেওয়া হয়নি। আমরা বলতে চাই, আমরা দুর্নীতিমুক্তভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।’

আরও পড়ুন >> দুদকের জাল ছিঁড়ে মুক্ত ৮৪ সরকারি কর্মকর্তা!

‘দুদকের অভিযানের পর আমরা বায়োমেট্রিক হাজিরা নিয়মিতভাবে মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছি। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত থাকে তাহলে তাদের শোকজ করা হবে। অফিস চলাকালীন প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিষয়টি আমার জানা নেই। এ ধরনের অভিযোগ আমি স্বীকার করি না বা কেউ আমার কাছে অভিযোগ করেনি। তারপরও কেউ যদি করে, সে দায়ী থাকবে।’

‘অভিযানের পর দুদক থেকেও আর কোনো অভিযোগ বা নির্দেশনা পাওয়া যায়নি’— বলেন অধ্যক্ষ ডা. মো. মনিরুজ্জামান।

দুদকের অভিযানের পর বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিক্ষোভ / ছবি- সংগৃহীত

অভিযোগে যা ছিল 

ডা. আনোয়ার হোসেন বাবলু শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও নিউরোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকলেও সপ্তাহে দুই বা তিন দিন অফিস করেন। নির্ধারিত সময়ে অফিসে না এসে বেলা ১১টা বা ১২টায় আসেন। তিনি বরিশালের মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাবএইড হাসপাতাল, সাউথ অ্যাপোলো মেডিকেল সার্ভিসেস কলেজ এবং প্রভৃতি মেডিকেল সেন্টার ও হাসপাতালের মাধ্যমে সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিনে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ২০০ থেকে ৩০০ রোগী দেখেন। হাসপাতালে আসা হতদরিদ্র ও দুস্থ রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন— এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য দুদকের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়।

দুদকের অভিযান

সরকারি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করা, হাসপাতালের চেয়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে অভিযান চালায় দুদক। সংস্থাটির বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রাজ কুমার সাহার নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি টিম অভিযানে নামে। অভিযানকালে অভিযোগের সত্যতা পায় টিম। সেখানে তারা দেখতে পান, হাসপাতালের চিকিৎসক আনোয়ার হোসেন বাবলু ও অমিতাভ সরকার সরকারি দায়িত্ব পালন না করে ব্যক্তিগত চেম্বারে প্রতিদিন রোগী দেখেন। এমনকি সরকার নির্ধারিত সকাল ৮টার অফিসেও তারা আসেন না। ওইদিন সকাল সোয়া ৯টার দিকে কলেজ অধ্যক্ষ ডা. মনিরুজ্জামান শাহিনের কক্ষে গেলে তাকে পায়নি দুদক টিম। এমনকি অফিসের একজন পিয়নও উপস্থিত ছিলেন না।

আরও পড়ুন >> পৌনে ৩ কোটি টাকার সম্পদে ফাঁসলেন স্ত্রীসহ পুলিশ কর্মকর্তা

দুদক টিমের আসার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে কার্যালয়ে আসেন কলেজ অধ্যক্ষ। দুদক টিম কলেজ অধ্যক্ষের কাছে চিকিৎসকদের এক সপ্তাহের বায়োমেট্রিক হাজিরার তালিকা দেখতে চান। তা দিতে অস্বীকার করেন কলেজ অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান শাহিন। শুধু তা-ই নয়, দুদকের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অভিযানকারী টিমের ছবি তুলে রাখার হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান অধ্যক্ষ।

অভিযানকালে সেবাপ্রত্যাশী রোগী ও ওয়ার্ডে চিকিৎসারত রোগীর স্বজনরাও হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কথা জানান। সরকারি দায়িত্ব পালনের চেয়ে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে সময় অতিবাহিত করা, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক হাসপাতালে রোগী পাঠানো, কমিশন বাণিজ্যসহ আরও বেশকিছু অভিযোগ আনেন তারা।

ওই ঘটনায় অভিযান পরিচালনাকারী টিমের বিচার চেয়ে উল্টো আন্দোলনে নামেন চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে মিছিলসহ ধর্মঘটের হুমকি দেয় তারা। এমনকি বিভাগীয় কমিশনার আমিন-উল আহসানের কাছে স্মারকলিপিও দেন চিকিৎসকরা।

আরএম/এমএআর