নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দিশেহারা তৃণমূল আওয়ামী লীগ। দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহতের সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে / ছবি- সংগৃহীত

• প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার হচ্ছে মারণাস্ত্র 
• আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সক্রিয় দুর্বৃত্তরা 
• নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ আ.লীগের

কয়েক মাস পরই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল আওয়ামী লীগ বেশ সক্রিয়। নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে তৃণমূলের গ্রুপিং ততই প্রকাশ পাচ্ছে। শুধু নির্বাচন নয়, ব্যক্তি-আক্রোশও দলের মধ্যে ফুটে উঠছে।

এদিকে, তৃণমূল আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণসহ নিজেদের বলয় সৃষ্টিতে আধিপত্য বিস্তারে মগ্ন নেতাকর্মীরা। স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চালানো হচ্ছে ‘পরিকল্পিত হামলা’। রাত-বিরাতে আক্রমণ, গুলি করে হত্যার ঘটনাও ঘটছে।

তৃণমূলের এমন আধিপত্য বিস্তার রুখতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতা নিহতের পর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নজরে আসে এমন হামলার বিষয়টি। তৃণমূলের এসব ঘটনার সঙ্গে নিজ দলের নেতারা জড়িত, না কি বিরোধীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত; তা নিয়ে সতর্ক ক্ষমতাসীনরা। পাশাপাশি নেতাকর্মীদের সতর্ক থেকে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা।

আরও পড়ুন >> সিটি নির্বাচনেও ‘ঘুম হারাম’ আওয়ামী লীগের

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। একটা অপশক্তি ষড়যন্ত্র করছে। তারা আমাদের দলে ঢুকে, আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। নিজেদের মধ্যে হানাহানি, বিবাদ তৈরিতে তারা সচেষ্ট। কিন্তু আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমরা যারা বিভিন্নভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত, আমরা সেভাবে নেত্রীর নির্দেশনা তৃণমূলে পৌঁছে দিচ্ছি। যাতে দল ঐক্যবদ্ধ থাকে।’

তৃণমূল আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণসহ নিজেদের বলয় সৃষ্টি করতে আধিপত্য বিস্তারে মগ্ন নেতাকর্মীরা। স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চালানো হচ্ছে ‘দুর্বৃত্ত হামলা’। রাত-বিরাতে আক্রমণ, গুলি করে হত্যার ঘটনাও ঘটছে 

‘নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। কিন্তু কোনো রকম হানাহানি, নোংরামি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান (বাঁয়ে) ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমাম / ছবি- সংগৃহীত 

দলীয় সূত্র মতে, গত কয়েক মাসে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজনকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করেছে। এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার। তৃণমূলের এসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না ক্ষমতাসীনরা। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও নজর রাখা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামীতে নির্বাচন, অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। বিরোধীদের নানা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি নিজ দলের কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হানাহানি, মারামারি, সংঘাতের মতো নোংরা রাজনীতির সমাধান করতে হবে

নিজ দলের কোনো নেতার ইন্ধন বা নিজস্ব বলয় সৃষ্টির কারণে তৃণমূলে হানাহানি-মারামারি কিংবা নোংরা রাজনীতির শিকার কেউ হচ্ছেন কি না, সে বিষয়েও খোঁজখবর রাখছেন সাংগঠনিক দায়িত্বশীলরা।

এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আগামীতে নির্বাচন, অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। বিরোধীদের নানা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি নিজ দলের কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হানাহানি, মারামারি, সংঘাতের মতো নোংরা রাজনীতির সমাধান করতে হবে।’

আরও পড়ুন >> ‘বাতিলদের’ তালিকা হচ্ছে, যোগ্য প্রার্থী খুঁজতে মাঠে গোয়েন্দারা

তিনি আরও বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসেও বেশকিছু জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার মতো ঘটনা আমরা দেখতে পেয়েছি। অনেক ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে। লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এক আওয়ামী লীগ নেতাকে আসামি করে মামলা হয়েছে শুনেছি। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, তাই বলে কাউকে মেরে ফেলতে হবে— এটা তো আওয়ামী লীগের রাজনীতি না।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগনেতা খাইরুল আলম, সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগনেতা আব্দুল কুদ্দুস ও রাজবাড়ীর ছাত্রলীগনেতা সেখ সবুজ। সবাই দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন / ছবি সংগৃহীত 

জানা গেছে, গত ২৫ এপ্রিল রাত পৌনে ১০টার দিকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতা নিহত হন। তারা হলেন- জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান (৩৫) ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম।

এদিকে, ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরশহরের উদয়ন মোড় এলাকায় শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা খাইরুল আলম জেমকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির অনুষ্ঠানে স্লোগান দেওয়া নিয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে সোনা মিয়া (৫৫) নামের এক আওয়ামী লীগের কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সমর্থকরা। গত ২৪ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে উপজেলার হারাগাছ খানসামা ইমামগঞ্জ স্কুলের সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সোনা মিয়া হারাগাছের নাজিরদহ এলাকার মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে। তিনি হারাগাছ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা খাইরুল আলম জেম হত্যায় গ্রেপ্তার আসামিরা / ছবি সংগৃহীত 

গত ২৩ এপ্রিল রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সেখ সবুজ (২৮) নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। জানা যায়, সবুজসহ কয়েকজন নিজ বাড়ির বসতঘরের মেঝেতে বসে ব্যবসায়িক হিসাব করছিলেন। রাত ১০টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত ঘরের জানালা দিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়। এ সময় সবুজ ও সজিব শেখ গুলিবিদ্ধ হন। তাদের উদ্ধার করে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সবুজ মারা যান।

আরও পড়ুন >> দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন : দলীয় কৌশলে ‘কূটকচাল’

এর আগের দিন অর্থাৎ ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় সিংড়া উপজেলার কলম ইউনিয়নের নুরপুর বাজারে আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব বিরোধের জেরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে গুরুতর আহত হন সাতজন। তিনজনকে নির্মমভাবে কোপানো হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের পাঠানো হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

গত ২৫ এপ্রিল রাত পৌনে ১০টার দিকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতা নিহত হন। তারা হলেন- জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান (৩৫) ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম 

গত ২৪ মার্চ খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ আনসার আলী দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। নগরীর খানজাহান আলী থানাধীন শিরোমণি এলাকার একটি ক্লিনিকের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দুর্বৃত্তদের গুলিতে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস নিহত হন। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে ১০ থেকে ১৫ জন অস্ত্রধারী উপজেলার ভোগলমান চারমাথা বাজারে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস সরকারের দোকানে ঢুকে খুব কাছ থেকে চারটি গুলি করে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই আব্দুল কুদ্দুস মারা যান।

এমএসআই/