আসন্ন বাজেটে এমপিও খাতে বেশি বরাদ্দ রাখতে এমপি-মন্ত্রীদের প্রচণ্ড চাপ থাকার পরও বরাদ্দ বাড়ছে না / ঢাকা পোস্ট

>> এমপিও খাতে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব
>> নির্বাচনী বছর হওয়ায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি ছিল এমপি-মন্ত্রীদের
>> পুরোনো খাতে বরাদ্দ না বাড়ানোর নির্দেশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের

দীর্ঘ ১০ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সাল থেকে নতুন করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) করা হয়। কথা ছিল প্রতি বছর নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ কার্যক্রমের আওতায় আসবে। কিন্তু করোনার কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে এমপিও দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর ২০২২ সালের বাজেটে এমপিওভুক্ত করার জন্য ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।

আসন্ন বাজেটে এমপিও খাতে বেশি বরাদ্দ রাখতে এমপি-মন্ত্রীদের প্রচণ্ড চাপ থাকার পরও এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো প্রস্তাবিত বাজেট বা সিলিং-এ এবারও ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আরও পড়ুন >> ফের আন্দোলনে যাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেট তৈরিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা হলো, নতুন কোনো খাত তৈরি করা যাবে না। পুরোনো খাতেও বরাদ্দ বাড়ানো যাবে না। এসব নির্দেশনা মাথায় রেখে আসন্ন বাজেটে গত অর্থবছরের ন্যায় এবারও এমপিও খাতের জন্য ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সে হিসাবে এবার বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই, বরং কমতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন বাজেট নির্বাচনী বছরের হওয়ায় এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি ছিল নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ও সংসদ সদস্যদের। কারণ, অনেক সংসদ সদস্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে গত বছর প্রায় তিন হাজার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলেও অনেক এমপির সুপারিশ করা প্রতিষ্ঠান বাদ পড়ে যায়। বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্য।

বাজেট তৈরিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা হলো, নতুন কোনো খাত তৈরি করা যাবে না। পুরোনো খাতেও বরাদ্দ বাড়ানো যাবে না / ঢাকা পোস্ট

এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে এ খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে আধা-সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন এমপি-মন্ত্রীরা। পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পেলে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেস্তে যেতে পারে। যার প্রভাব পড়তে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

আরও পড়ুন >> এমপিদের জন্য নির্বাচনী পুরস্কার, এমপিও হচ্ছে ১০০ প্রতিষ্ঠান!

বাজেট শাখা সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে ২৫০ কোটি টাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তরের জন্য, বাকি ৫০ কোটি টাকা মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবারও বাজেটে এমপিও খাতের জন্য আগের বছরের ন্যায় ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ খাতে বাজেট বাড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবার বাজেট তৈরিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সেটা মেনেই বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের এমপিও শাখা সূত্রে জানা যায়, প্রায় এক যুগ বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করার অনুমোদন দেয় সরকার। এমপিওজট কমাতে প্রতি বছর এমপিওভুক্ত করা হবে বলে জানান তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এরপর দুটি এমপিও দিলেও সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের নির্বাচনী এলাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ পড়ে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ছিল এমন প্রতিষ্ঠানও ওই তালিকায় থেকে যায়। পরে আধা-সরকারিপত্রের (ডিও লেটার) মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে চাপ দেন তারা। কিন্তু অপর্যাপ্ত বাজেটে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকের ধারণা ছিল এবার নির্বাচনী বছর হওয়ায় এ খাতে হয়তো বরাদ্দ বাড়বে। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি অবস্থা!

এবারও বাজেটে এমপিও খাতের জন্য আগের বছরের ন্যায় ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় / ঢাকা পোস্ট

আরও পড়ুন >> এক শি‌ক্ষিকার এম‌পিও নিয়ে তোলপাড়

এদিকে, চলতি অর্থবছর দুই হাজার ৯৭১টি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দফায় গত বছরের ৬ জুলাই দুই বিভাগের অধীনে দুই হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। তখন অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ পড়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীনে এক হাজার ৯১৬টি মাদ্রাসা ও কারিগরি পর্যায়ের প্রায় এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য আপিল করে। আপিল নিষ্পত্তি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গত ১২ জানুয়ারি আরও ২৫৫টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিগগিরই শুরু হচ্ছে এমপিওভুক্ত হওয়ার নতুন আবেদন

বাদ পড়া ও নতুন করে যোগ্য হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করতে শিগগিরই শুরু হচ্ছে নতুন আবেদনপত্র নেওয়া। এজন্য বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (ব্যানবেইস) আবেদন নেওয়ার সফটওয়্যার প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। আগের গঠিত বাছাই কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। নতুন আবেদনপত্র নেওয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সচিবের কাছে অনুমতি চেয়েছে এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি। সচিবের অনুমতি পাওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আবেদনপত্র চাওয়া হবে।

বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্য। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে এ খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে আধা-সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন এমপি-মন্ত্রীরা। পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পেলে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেস্তে যেতে পারে। যার প্রভাব পড়তে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক অধি-শাখা) সোনা মনি চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন আবেদনপত্র নেওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ। আবেদনপত্র নেওয়ার ফাইলে সচিব অনুমোদন দিলে একটি মিটিং করে আবেদনপত্র চাওয়া হবে।

নীলফামারীর মডার্ণ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। গত বছরের ৬ জুলাই প্রকাশিত এমপিওভুক্তির তালিকায় নাম এসেছে শিক্ষার্থীবিহীন প্রতিষ্ঠনটির/ ঢাকা পোস্ট

যেভাবে হবে যাচাই-বাছাই

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটি হয় নয় সদস্যের। এ কমিটিকে বলা হয় ‘প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটি’। তারা সর্বশেষ এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্য প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে এমপিওভুক্ত করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের আবেদনের তথ্যে কোনো অনিয়ম বা অসামঞ্জস্য থাকলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও সরকারের কাছে সুপারিশ করে কমিটি।

আসন্ন বাজেটে এমপিও খাতে বেশি বরাদ্দ রাখতে এমপি-মন্ত্রীদের প্রচণ্ড চাপ থাকার পরও এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো প্রস্তাবিত বাজেট বা সিলিং-এ এবারও ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় 

এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (বেসরকারি মাধ্যমিক)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ব্যানবেইস মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক), যুগ্ম সচিব (আইন), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক), পরিচালক (কলেজ), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব (কলেজ), জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব (বাজেট) এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন যুগ্ম সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক-৩)।

আরও পড়ুন >> শোক দিবসের সভায় অনুপস্থিত, এমপিও স্থগিত হচ্ছে ৫ মাদ্রাসার!

অন্য কমিটি হলো ‘কারিগরি কমিটি’। এ কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্র নেওয়া এবং প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করবে। কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করে আবেদনপত্র গ্রহণ এবং তা সফটওয়্যারে প্রসেস করে একটি তালিকা প্রস্তুত করবে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরে গ্রেডেশন তালিকা ‘প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটির’ কাছে উপস্থাপন করবে এ কমিটি।

এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ব্যানবেইস মহাপরিচালকে। সাধারণত আট সদস্যের কারিগরি এ কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট, প্রোগ্রামারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।

গত বছর প্রায় ৩ হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলেও অনেক এমপির সুপারিশ রাখা যায়নি। বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্য / ঢাকা পোস্ট

এমপিওভুক্তির নীতিমালায় যা আছে

এমপিও নীতিমালা- ২০২১ অনুযায়ী, ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত করা হয়। ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর), পরীক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর) এবং পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার (৪০ নম্বর)। তবে, এ নীতিমালার ২২ ধারায় বিশেষ ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে এমপিওভুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।

২২ ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষায় অনগ্রসর, ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি এলাকা, হাওর-বাওড়, চরাঞ্চল, ছিটমহল, বস্তি এলাকা, নারীশিক্ষা, সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠী (প্রতিবন্ধী, হরিজন, সেবক, চা-বাগান শ্রমিক, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি) এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, চারুকলা, বিকেএসপিসহ সংস্থা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলযোগ্য।

এনএম/এসকেডি/এমএআর