সবকিছু বন্ধ থাকায় ট্রাভেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন

বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘুরতে যেতেন ভ্রমণপিপাসু বাংলাদেশিরা। গত চার/পাঁচ বছর ধরে এটি যেন তাদের নেশায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বাধ সাধে করোনা মহামারি। অদৃশ্য এ ভাইরাসের কারণে টানা দুই বছর ধরে ভ্রমণপিপাসুদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ হওয়ায় মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়েছেন ট্যুর অপারেটররা। ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ায় মারাত্মক দুশ্চিন্তায় তারা। অনেকে আবার এ ব্যবসা ছেড়ে অন্যকিছু করার চিন্তায় আছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবানরা মূলত পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের পরদিনই ছুটি কাটাতে ছুটে যেতেন থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের মতো এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে। কেউ আবার ঈদের আগের দিনই চলে যেতেন। ঈদ উদযাপন করতেন ভিন্ন আমেজে।

কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। আরোপ করা হয় কঠোর বিধিনিষেধ। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে লকডাউনসহ ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে দেশেই ঈদ উদযাপনে বাধ্য হন ভ্রমণপিপাসুরা। এবারও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

করোনার কারণে টানা দুই বছর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় লোকসানের মুখে পড়েন ট্যুর অপারেটররা। তারা জানান, গেল বছরের ন্যায় এবারও চলমান বিধিনিষেধের কারণে গত এক মাস ধরে কোনো আয় নেই। বসে বসে অফিস ভাড়া দিচ্ছেন। কর্মীদের বেতন কমিয়েও টিকে থাকতে পারছেন না  অনেকে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় চার হাজার প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। করোনা তাদের জীবিকাও হুমকির মুখে ফেলেছে। অনেকে আবার এ খাত ছেড়ে অন্যকিছু করার চিন্তাভাবনা করছেন

তারা বলছেন, বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের ট্রাভেল ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। ট্যুর অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্সি। ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বিদেশে জনশক্তি রফতানি, হজে লোক পাঠানো, টিকিট কাটার মতো কাজ করেন। তবে ট্যুর অপারেটররা একজন ভ্রমণপিপাসুকে বিদেশে ঘোরার জন্য ভিসা সহযোগিতা, টিকিট ও হোটেল বুকিংসহ আকর্ষণীয় স্পটগুলো ঘুরে দেখানোসহ সবধরনের সহযোগিতা করে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ভ্রমণপিপাসুরা ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে ঘুরতে যেতেন। কেউ কেউ আবার দুবাই-তুরস্কে যেতেন। কিন্তু করোনার কারণে বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অনেক দেশ আবার বাংলাদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে ট্যুর অপারেটরদের আয় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পর্যটন ব্যবসার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে বলে দাবি তাদের।

ঈদের পরপরই ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান বিশ্বের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে। কিন্তু এবার সেটা হচ্ছে না

অ্যামেজিং ট্যুরস বিডির ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে একের পর এক দেশ বাংলাদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মার্চে বাংলাদেশ থেকে দীর্ঘদিন ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর ফ্লাইট চালু হলেও মানুষের ঘোরাফেরা অনেকাংশে কমে যায়। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোটামুটি লোকজন দেশের ভেতরে ভ্রমণ করে। ফলে অভ্যন্তরীণ কিছু ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি হয়। এতে অফিস খরচের ৪০ থেকে ৫০ ভাগ উঠে আসে। তবে নতুন করে একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে কোনো আয় নেই। উল্টো যারা টাকা দিয়ে টিকিট কেটে রেখেছিলেন তাদের টিকিট বাতিল করে টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে।

শেয়ার ট্রিপের ব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব বিভাগ) সৌমনাথ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষের মুভমেন্ট (চলাচল) যত বেশি হবে আমাদের ব্যবসা তত ভালো হবে। সব জায়গায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা চলছে। অনেক দেশ বাংলাদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গোটা এভিয়েশন ও ট্যুরিজম খাতের জন্য এটা চরম সংকটাপন্ন অবস্থা। তারপরও আমরা কোনো মতে টিকে থাকার চেষ্টা করছি।

হুমকির মুখে ২০ লাখ মানুষের জীবিকা

বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় চার হাজার প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। করোনা তাদের জীবিকাও হুমকির মুখে ফেলেছে। অনেকে আবার এ খাত ছেড়ে অন্যকিছু করার চিন্তাভাবনা করছেন।

সার্চ ট্রাভেলসের ম্যানেজার আহসান উল্লাহ বলেন, ‘কেউ সুন্দরবনে গেলে প্রথমে তিনি ঢাকা থেকে প্লেনে আশপাশের এয়ারপোর্টে যান। সেখান থেকে মাইক্রোবাস বা প্রাইভেটকার ভাড়া করে সুন্দরবনে যান। সেখানে গিয়ে জাহাজে অবস্থান করেন। এভাবে একজনের ট্যুরের সঙ্গে চার-পাঁচ ধরনের ব্যবসায়ীর জীবিকা নির্বাহ করে। গত কয়েক মাস ধরে এ ব্যবসা স্থবির হয়ে আছে।‘

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) বর্তমান সদস্য ৭৩১ জন। এর মধ্যে প্রায় ৬০-৬৫ ভাগ অপারেটর টানা লোকসানের কারণে বন্ধের সম্মুখীন। তারা নিয়মিত অফিস খরচ আর কর্মীদের বেতন দিতে পারছেন না। বিধিনিষেধ আর কিছুদিন থাকলে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন তারা

ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) বলছে, তাদের বর্তমান সদস্য ৭৩১ জন। এর মধ্যে প্রায় ৬০-৬৫ ভাগ অপারেটর টানা লোকসানের কারণে বন্ধের সম্মুখীন। তারা নিয়মিত অফিস খরচ আর কর্মীদের বেতন দিতে পারছেন না। বিধিনিষেধ আর কিছুদিন থাকলে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন তারা।

করোনার কারণে কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়ায় দেশের ভেতরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও লোকসমাগম কমে গেছে

টোয়াবের সভাপতি রাফেউজ্জামান বলেন, করোনাকালীন টোয়াবের সদস্যদের পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমত যে, কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তবে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই টিকে থাকতে পারবে না। আমরা সরকারকে বারবার বলেছি, এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের যেন প্রণোদনা দেওয়া হয়। অন্তত ওয়ার্কিং ক্যাপিটালটা ঋণ হিসাবে পেলেও আমরা মোটামুটি ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারব। এছাড়া আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ারও আহ্বান জানাচ্ছি।

ট্যুর অপারেটরদের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা তাদের প্রস্তাবগুলো শুনেছি। তাদের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে।’ 

তালা দিতে হবে অনেক রিসোর্টে

ঢাকার আশপাশে ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয় স্পট ছিল সাভার ও গাজীপুরের রিসোর্টগুলো। তবে গত বছর প্রায় চার মাস এবং এ বছর দেড় মাস বন্ধের কারণে তাদের লোকসানও আকাশছোঁয়া।

অতিথি না আসায় গত এক বছরে রিসোর্টগুলোর ক্ষতি প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, বলছেন সংশ্লিষ্টরা

রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অধিকাংশ রিসোর্ট আয়তনে অনেক বড়। এখানকার প্রতিদিনের পরিচালন ব্যয় দেশের তিন ও চার তারকা মানের আবাসিক হোটেলগুলো থেকে কোনো অংশে কম নয়। গত বছর চার মাস ব্যবসা বন্ধ ছিল। রিসোর্ট খোলার পর দু-তিন মাস লোকজন ছিল না। যখনই ব্যবসা কিছুটা শুরু হলো তখনই আবার করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেল। এরপর সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করল। এবারের ঈদের পর অধিকাংশ রিসোর্টের রুম বুকিং ছিল। তবে বিধিনিষেধের কারণে সেগুলো বাতিল করতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে রিসোর্টে তালা ঝুলাতে হবে।

ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ট্রিয়াব) সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত এক বছরে আমাদের ২১ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমরা আর টিকে থাকতে পারব না। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার প্রণোদনার কথা বললেও এখনো তা পাওয়া যায়নি। ব্যাংকগুলোও আমাদের ঋণ দিচ্ছে না।

এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে বলেও জানান তিনি।

এআর/এসকেডি/এমএআর