ঈদের দিনেও হাসপাতালে কর্তব্যরত তারা। কাগজে ঈদ মোবারক লিখে শুভেচ্ছা বিনিময়ের চেষ্টা

দেশ এখন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কঠিন সময় পার করছে। করোনার শুরু থেকে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্তদের সেবা দিয়ে আসছেন। সংক্রমণ শুরুর পর থেকে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারছেন না তারা। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকা রোগীদের সেবার মাঝেই তারা ঈদ আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন।

শুক্রবার (১৪ মে) সারাদেশে পবিত্র ঈদুল ফিতর পালিত হচ্ছে। এ দিনেও দায়িত্ব-কর্তব্যের বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে।

দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের সময় রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে যে কজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে করোনা চিকিৎসা শুরু হয়, তাদের একজন ডা. আল মামুন শাহরিয়ার সরকার। দুই বছর ধরে হাসপাতালের রোগীদের সঙ্গে ঈদ কাটাচ্ছেন তিনি। তবুও চোখে-মুখে নেই ক্লান্তি বা হতাশার ছাপ। ঈদ কেমন কাটছে— প্রশ্ন করা হলে মুচকি হেসে তিনি বলেন, পরিবারের সঙ্গে ঈদ নয় বরং রোগীদের সেবা এবং তাদের সুস্থতায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। এ আনন্দের সঙ্গে অন্যকিছুর তুলনা নাই।

ঈদ কেমন কাটছে— প্রশ্ন করা হলে মুচকি হেসে ডা. আল মামুন শাহরিয়ার বলেন, পরিবারের সঙ্গে ঈদ নয় বরং রোগীদের সেবা এবং তাদের সুস্থতায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। এ আনন্দের সঙ্গে অন্যকিছুর তুলনা নাই

ডা. আল মামুন শাহরিয়ার বলেন, এখনকার ঈদগুলো আসলে আমাদের জন্য একটু আলাদা। সবাই যখন নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করছেন, তখন আমরা কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। গত বছরের ঈদটাও আমাদের এভাবে কেটেছে। এ বছর বাসা থেকে সরাসরি হাসপাতালে এসে ডিউটি করলেও গত বছর হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম। সেখান থেকে এসে হাসপাতালে ডিউটি করি।

তিনি আরও বলেন, এবার সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে ঈদের নামাজ পড়ি। তারপর ৮টার দিকে হাসপাতালে আসি। এখানে এসে রোগী দেখা শুরু করলাম। একদিক থেকে এটি আমাদের ভালোই লাগে। কারণ, দিনটি কাজের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগে এ চিন্তা করে যে, সবাই যেখানে খাচ্ছেন, আনন্দ করছেন; আমরা সেখানে মানুষকে সেবা করছি, রোগীদের জন্য কিছু করতে পারছি।

করোনা শুরুর পর থেকে প্রতিটা ঈদই তাদের কাটছে হাসপাতালে থাকা রোগীদের সেবা দিয়ে  

বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনদের কথা মনে পড়লে কিছুটা খারাপ লাগে। তবে তা নিয়ে মনে কোনো কষ্ট নেই। বরং, মানুষের সেবায় নিয়োজিত, এটা ভাবে মানসিক তৃপ্তি লাগে— যোগ করেন করোনার সম্মুখসারির এ যোদ্ধা।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এফসিপিএস কোর্স করছেন, সঙ্গে ঈদের দিনেও মানুষের সেবায় নিয়োজিত এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করে বলেন, মাঝে মাঝে একটু খারাপ তো লাগেই। ঈদের দিন সকালে দৌড় দিয়ে হাসপাতালে আসতে হয়েছে। এখানকার মানুষগুলোও তো অসহায়। তাদের সঙ্গেই ঈদের আনন্দটা ভাগাভাগি করে নেই।  

তিনি আরও বলেন, ‘রোগীরাও তো আশা রাখেন, ঈদের দিন তাদের কেউ দেখতে আসবেন। এদিন হাসপাতালে এলে তারা বলেন, ডাক্তার সাহেব, আপনি আজও আসছেন? ঈদের দিনেও আপনি আমাদের সঙ্গে? তাদের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে আমরা অনেক কিছুই ভুলে যাই। ঈদের কষ্টটাও মনে থাকে না, চাপা পড়ে যায়। এ রোগীগুলোর কষ্টের চেয়ে আমাদের কষ্ট বেশি বড় নয়।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (এনসিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবারের ঈদে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কারও ছুটি হয়নি। সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলে ঈদ উদযাপন করছেন। আমরা যারা স্বাস্থ্য অধিদফতরে আছি, গতকালও আমাদের মিটিং হয়েছে, আজও আমরা নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত। বিশেষ করে আমাদের চিকিৎসক-নার্সরা দিন-রাত হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, গত দুই বছর ধরে ঈদ সেভাবে করা যাচ্ছে না। তারপরও আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। মহামারি কাটিয়ে দ্রুত স্বাভাবিক সময় ফিরে আসুক, এটা আমাদের প্রত্যাশা। তারপর ভালো করে ঈদের আনন্দ করা যাবে।’

মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ না করে তারা রোগীদের সেবা করে যাচ্ছেন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স ও স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) মহাসচিব মো. ইকবাল হোসেন সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে নার্সসহ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ঈদের ছুটি বন্ধ। সেই ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের প্রতিটি ঈদ করতে হয়েছে হাসপাতালে। না পারছি পরিবারকে সময় দিতে, না পারছি আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধবকে সময় দিতে। আসলে কিছুই তো করার নেই।

‘তবে দীর্ঘ একটা সময় বাবা-মাসহ আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকায় আমরা মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত। তারপরও আমরা আনন্দিত এ কারণে যে, এমন একটা দুর্যোগে আমরা মানুষের পাশে থেকে সেবা দিতে পারছি। এর মধ্যেই আমরা আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি। এছাড়া তো বিকল্প কিছু নেই। যেহেতু আমাদের পড়াশোনা আর কাজটা হলো মানবতাকেন্দ্রিক, সেহেতু আমাদের মানবতার সেবার মধ্যেই আনন্দ খুঁজতে হবে’— যোগ করেন তিনি।

পেশাজীবী নার্সদের এ নেতা বলেন, আমরা আমাদের বাবা-মায়ের কাছে যেতে পারছি না। তাদের সেবা করতে পারছি না। আপনারা তাদের জন্য দোয়া করবেন— এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের জন্যও দোয়া করবেন, যেন আমরা সুস্থ থাকি। কারণ, আমরা সুস্থ থাকলে দেশের মানুষকেও সুস্থ রাখতে পারব।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মো. খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে এবারের ঈদে ডাক্তার-নার্সসহ কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর ছুটি হয়নি। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে দূরে রেখে রোগীদের সঙ্গে তারা ঈদ করছেন। তাদের সেবার মধ্যেই তারা ঈদের আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন।

রোগীদের সেবা ও সুস্থতার মধ্যেই আমাদের ঈদ আনন্দ, বলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা

তিনি বলেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা যেন আবার মাস্ক ছাড়া একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা করতে পারি, কথা বলতে পারি। আগামী ঈদ যেন আমরা আমাদের পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারি। তাদের নিয়ে ঘুরতে পারি, আনন্দ করতে পারি। করোনা মহামারি যেন এ সময়ের মধ্যে বিদায় নেয়।

অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, করোনার সময় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার অনেক মানুষ মারা গেছেন। এখন পর্যন্ত করোনায় আমরা এতসব গুণী মানুষকে হারিয়েছি, যা কখনও ভোলার নয়। আমাদের অসংখ্য চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন। বিশেষ করে এ সময় অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মারা গেছেন। এটা আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা শোকাহত।

টিআই/আরএইচ/এমএআর/