রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে

ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১ ধারা অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসার জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার পথ আপাতত বন্ধ। তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে হলে একটিমাত্র পথ খোলা আছে। তা হলো ‘দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা’। তবে খালেদা জিয়াকে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার আবেদনের বিষয়ে রাজি করানো যায়নি। 

ফলে আপাতত বিদেশ নয়, দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। এরপরও তার বিদেশযাত্রার উদ্যোগ থেমে নেই। এখনো পর্দার আড়ালে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতার দেনদরবার চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, একটি মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় সরকারের হুকুমে আদালত খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়েছেন। তিনি দুই বছরের বেশি কারাভোগ করেছেন। করোনার শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কারাগারে রাখা ‘নিরাপদ’ বোধ না করায় সরকার নির্বাহী আদেশে মুক্তি দিয়ে ঘরবন্দি করেছে। শুরুতে সরকার তাকে বাসা থেকে চিকিৎসা নিতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেয়। তৃতীয় দফায় তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়। সেটা মঞ্জুর করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাসার বাইরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি বিএনপির পক্ষ থেকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় নেওয়া অনুরোধ জানানো হয়েছিল। দল ও পরিবার কেউ তার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি চান না। শুরুতে সরকারও বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় নেওয়ার মনোভাব দেখায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কেন তারা সরে আসল তা বোধগম্য নয়। তাই বলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। এখনও সুযোগ আছে

পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার আবেদন করলে সরকারের পক্ষে থেকে প্রথমে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়। ওই সময় বিএনপির নেতারা মনে করেছিলেন যে সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে এসেছে। তাকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দেবে। কিন্তু সরকারের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষ তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শেষ মুহূর্তে এসে মানবিক বিবেচনায় বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে সরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি শুরু করে— এমন অভিযোগ বিএনপির নেতাদের।

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া

তারা বলছেন, মানবিক একটি বিষয় নিয়ে সরকার রাজনীতি করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল (সরকার) রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে খালেদা জিয়া সাজা স্থগিতের আবেদন করুক। তাহলে তারা সেটা দেশে-বিদেশে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে পারবে। কিন্তু খালেদা জিয়া সেই পথে হাঁটতে রাজি হননি। তাই এ মুহূর্তে উন্নত চিকিৎসার জন্য তার বিদেশ যাওয়া হচ্ছে না। তবে, এর বাইরে অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় তাকে বিদেশে নেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে পর্দার আড়ালে খালেদা জিয়ার পরিবার ও সরকারের মধ্যে দেনদরবার চলছে। এখন সেটা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে এবং কত দিন সময় লাগবে সেটাই দেখার বিষয়।

সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে অনুমতি না মেলায় পরবর্তীতে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না— জানতে চাইলে ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আপাতত কোনো উদ্যোগের বিষয়ে আমার জানা নেই।’

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পরিবারের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার আবেদনের পর আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে তারা অনুমতি দেবেন। কিন্তু পরে দেখতে পেলাম, সরকার তার চিকিৎসা নিয়ে প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেছে।’ খালেদা জিয়ার কিছু হলে এর দায়দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রিন্স বলেন, ‘ম্যাডামের চিকিৎসার বিষয়টি তার পরিবার দেখছে। বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিবারের পক্ষ থেকেই নেওয়া হবে।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষমা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে হলে তো খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর নিতে হবে। আমি যতটুকু শুনেছি এবং তাকে (খালেদা জিয়া) যতটুকু জানি, এ প্রক্রিয়ায় কোনোদিনই তিনি রাজি হবেন না। অন্যদিকে, সরকারের ভেতরের একটি পক্ষ খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় তার বিদেশে চিকিৎসা নেওয়াটা প্রায় অনিশ্চিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সাজা মাফের আবেদন করে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগও থেমে নেই। পর্দার আড়ালে উভয়পক্ষের উদ্যোগ চলমান আছে। আগের সাজা স্থগিতের শর্তের সঙ্গে আরও কিছু শর্ত জুড়ে বা কমিয়ে বিদেশে নেওয়ার অনুমতির বিষয়ে একটা সমঝোতা হতে পারে। তবে সেটা হতে কতদিন লাগবে বা আদৌও সমঝোতা হবে কি না— এমন নিশ্চয়তা দিতে পারেননি তিনি।

এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া পানি পান করছেন

সূত্রটি আরও বলছে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি বিএনপির পক্ষ থেকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় নেওয়া অনুরোধ জানানো হয়েছিল। দল ও পরিবার কেউ তার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি চান না। শুরুতে সরকারও বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় নেওয়ার মনোভাব দেখায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কেন তারা সরে আসল তা বোধগম্য নয়। তাই বলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। এখনও সুযোগ আছে।

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্বেগ

গত ১১ মে’র পর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিএনপি বা তার চিকিৎসক দলের পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ সম্মেলনে বা ব্রিফ করা হয়নি। ফলে গত ছয় দিনে বিএনপিপ্রধান কেমন আছেন, তার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা কী— তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সারাদেশের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের তো খালেদা জিয়ার চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ নেই। হাতে গোনা কিছু নেতা চিকিৎসকদের কাছে থেকে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে পারছেন। তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায় হতাশা ও উদ্বেগের মধ্যে দিনপার করছেন তারা।

এ বিষয়ে ফেনী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবু তাহের ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা থাকি ফেনীতে আর নেত্রীর চিকিৎসা চলছে ঢাকায়। তার খোঁজ পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে মিডিয়া। এর বাইরে তো কোনো পথ নেই। গত কয়েক দিন তো আমরা তার খোঁজ পাচ্ছি না। হতাশ তো হবই।’ 

তিনি আরও বলেন, আমরা নেত্রীর সুস্থতার জন্য দোয়া মাহফিল করে যাচ্ছি। আল্লাহ যেন তাকে দ্রুত সুস্থ করে তোলেন।

খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা কী— জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি আগের মতোই আছেন। 

এ বিষয়ে জানতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসকদের মধ্যে ডা. জাহিদ হোসেন ও ডা. আল মামুনকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলী এক সদস্য বলেন, আগে তো নেতা-নেত্রীদের কেউ কেউ খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে যেতেন। তখন চিকিৎসকদের কাছ থেকে খোঁজ নিতে পারতেন। কিন্তু এখন এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে অনুরোধ করেছে যে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কেউ যেন ভিড় না করে। তারা ব্যবসায়িকসহ নানাবিধ চাপে আছেন। ফলে, সেই সুযোগ এখন আর নেই।

গত ১১ মে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, খালেদা জিয়া এখনও বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন। তার কিডনির সমস্যা আছে। দ্যাটস এ রিয়েল প্রবলেম (এটাই আসল সমস্যা), তার হার্টেরও সমস্যা আছে। যেটা নিয়ে চিকিৎসকরা এখনো অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

এএইচআর/এমএআর/