সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে নন-কটন পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হোক। এটি দিলে আসছে অর্থবছর থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের বাড়তি রফতানি আয় যোগ করতে পারব। প্রতি বছরই রফতানি আয়ে দুই বিলিয়ন ডলার করে যোগ হতে থাকবে। ফলে একদিকে দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, অন্যদিকে রফতানি আয়ও বাড়বে; সঙ্গে নতুন নতুন বিনিয়োগ হবে…

বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক তুলার তৈরি পোশাকের চেয়ে এখন নন-কটন বেইজড অর্থাৎ কৃত্রিম তন্তু বা ম্যান মেড ফাইবার দিয়ে তৈরি পোশাকের চাহিদা বেশি। বাজারে তৈরি পোশাকের এক-চতুর্থাংশ নন-কটনের দখলে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ হয়েও পিছিয়ে রয়েছে। বস্ত্র খাতের নতুন এ বাজার ধরতে এখনই কটনের পাশাপাশি নন-কটনের তৈরি পণ্য রফতানিতে জোর দিতে হবে। এজন্য সরকারের নীতি-সুবিধাসহ এসব পণ্য রফতানিতে প্রণোদনার প্রয়োজন। তাহলে খুব সহজেই এ বাজারে প্রবেশ করা যাবে। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বিনিয়োগও বাড়বে। পাশাপাশি বাড়তি দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের রফতানি আয় অর্জন করা সম্ভব— এমনটি মনে করেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের কর্ণধার ফারুক হাসান

২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়া এবং করোনা মহামারিতে দেশের বৃহৎ তৈরি পোশাক খাতের সার্বিক অবস্থা, আগামীর চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শফিকুল ইসলাম

দেশের ৭৫ শতাংশ পোশাক তৈরি হয় প্রাকৃতিক তুলা থেকে তৈরি সুতা দিয়ে

ঢাকা পোস্ট : ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ফারুক হাসান : ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে দেশীয় পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন বাজেটকে আমি বলব আশাব্যঞ্জক, ভারসাম্যপূর্ণ ও ব্যবসাবান্ধব।

ঢাকা পোস্ট : ভারসাম্যপূর্ণ ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট বলছেন। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের জন্য বিশেষ কোনো ঘোষণা নেই। এ বিষয়ে কী বলবেন?

ফারুক হাসান : বাজেটে তৈরি পোশাক খাত নিয়ে সরাসরি কোনো ঘোষণা নেই। আমরা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পোশাক খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের কাছে বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবে বাজেট পাসের আগেই দাবিগুলো পুনর্বিবেচনা করবে সরকার— এমনই প্রত্যাশা আমাদের।

আমাদের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- রফতানি পণ্যের ওপর আরোপিত দশমিক ৫ শতাংশ উৎসে কর আগামী পাঁচ বছর বহাল রাখা এবং নন-কটন পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। আশা করি সরকার এগুলো পুনর্বিবেচনা করবে।

ঢাকা পোস্ট : করোনা মহামারির আঘাতে রফতানিতে বড় ধাক্কা খেয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। ক্ষতি কাটিয়ে কবে নাগাদ এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?

ফারুক হাসান : তৈরি পোশাক শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা আছে। যদিও এখন আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। কিন্তু আমাদের মার্কেট শেয়ার মাত্র ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ এ খাতে আমাদের আরও অনেক উন্নতির সুযোগ আছে। আমি মনে করি, আমরা যেভাবে কাজ করছি তাতে চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারব। অর্থাৎ বর্তমানে কোভিডের যে সময় পার করছি তা থেকে উত্তরণ করে প্রি-কোভিড সিচুয়েশনে যেতে পারব।

বিশ্বে বর্তমানে মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশ পোশাকই তৈরি হয় কৃত্রিম তন্তু বা ম্যান মেড ফাইবার দিয়ে 

মহামারির আগে আমাদের ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হতো। এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। নতুন করে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হলে আশা করছি আসন্ন অক্টোবর নাগাদ আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারব আমরা।

ঢাকা পোস্ট : ঘুরে দাঁড়াতে কোন বিষয়ের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন?

ফারুক হাসান : রফতানিতে নন-কটন পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ, সারা দুনিয়ায় এখন নন-কটন পোশাকের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। বিশ্বে বর্তমানে মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশ পোশাকই নন-কটনের তৈরি। কিন্তু আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। আমাদের রফতানি পোশাকের ৭৫ শতাংশ কটন বেইজড অর্থাৎ প্রাকৃতিক তুলার তৈরি পোশাক। মাত্র ২৫ শতাংশ রফতানি করছি নন-কটন পণ্য। তার মানে, এখানে নন-কটনের একটি বড় সম্ভাবনা আছে। তাই এখন কটন পণ্যের রফতানি অব্যাহত রেখে নন-কটনেও জোর দিতে হবে। যেহেতু এ পণ্যের চাহিদা আছে তাই আমরা মনে করছি এখনই প্রস্তুতি নিতে পারলে খুব সহজে এ বাজারে প্রবেশ করতে পারব।

ঢাকা পোস্ট : এক্ষেত্রে আপনারা কোন ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন?

ফারুক হাসান : গত কয়েক বছর ধরে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে। অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। অত্যাধুনিক মেশিনারিজ স্থাপন ও টেকনোলজি আপডেট করা হচ্ছে। আমাদের ক্যাপাসিটি (সামর্থ্য) আছে। এখন সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে নন-কটন পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হোক। এটি দিলে আসছে অর্থবছর থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের বাড়তি রফতানি আয় যোগ করতে পারব। প্রতি বছরই রফতানি আয়ে দুই বিলিয়ন ডলার করে যোগ হতে থাকবে। এতে একদিকে দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, অন্যদিকে রফতানি আয়ও বাড়বে; সঙ্গে নতুন নতুন বিনিয়োগ হবে। ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি আরও চাঙা হবে।

নন-কটন পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা চান বিজিএমইএ সভাপতি

ঢাকা পোস্ট : সারা বিশ্বই করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক শিল্পকে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে?

ফারুক হাসান : পুরো বিশ্বই এখন কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পও কঠিন সময় পার করছে। করোনার কারণে আমাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রথমত, করোনার কারণে বিশ্বে পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। ফলে আমরা ক্যাপাসিটি অনুযায়ী কারখানা পরিচালনা করতে পারছি না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালাতে গিয়ে খরচ বেশি হচ্ছে। এছাড়া কনটেইনার ও শিপিং কস্ট বেড়েছে। মহামারির মধ্যেও তুলা, সুতা ও কাপড়ের দাম বাড়তি। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়ায়নি। এসব বাস্তব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে।

ঢাকা পোস্ট : চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায় এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বিষয়ে যদি বলতেন…

ফারুক হাসান : সব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সম্ভাবনাও থাকে। বর্তমান সময়টি যেমন বড় চ্যালেঞ্জের তেমনি বেশকিছু সম্ভাবনার পথও উন্মুক্ত হয়েছে। পণ্য রফতানির নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা আছে। এখন দরকার সরকারের নীতি-সহায়তা, পাশাপাশি বায়ারদের (ক্রেতা) সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করা। তাহলে রফতানি বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙা করতে পারব।

করোনার কারণে পোশাক খাতের পণ্য রফতানির পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে

ঢাকা পোস্ট : নীতি-সহায়তা বলতে সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা করছেন?

ফারুক হাসান : কারখানা পরিচালনা এবং নতুন নতুন রফতানি বাজারে যেতে হলে বেশকিছু সহযোগিতার প্রয়োজন। এখন কারখানা পরিচালনার যে নিয়মগুলো আছে, সেগুলো আরও সহজ করা যেতে পারে। ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ‘ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ’ সূচকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের অবস্থান ১৬৮তম। এখানে অনেক উন্নতি করতে হবে। তাহলে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে। প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সহজে প্রতিযোগিতা করা যাবে।

এছাড়া সরকারের একদিকে পলিসি সাপোর্ট, অন্যদিকে ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দরকার। যখন যেটা প্রয়োজন সময় মতো তা দিতে হবে। আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে। যেমন- এখন নন-কটনের চাহিদা বেশি। এ খাতের জন্য প্রণোদনা যদি এখনই দেওয়া হয় তাহলে আমরা সহজেই বাজার ধরতে পারব। রফতানি বাড়াতে পারব।

এসআই/জেডএস/এমএআর/