পি কে হালদার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদারের মাধ্যমে কানাডায় ৮১ কোটি টাকা পাচার করেন / প্রতীকী ছবি

আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) তার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদারের মাধ্যমে কানাডার বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডিয়ান ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮১ কোটি টাকা পাচার করেছেন। ওই অর্থ ফেরাতে কানাডায় মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পি কে হালদার তার ভাই প্রীতিশ কুমার ও একটি বেনামি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে কানাডার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে সমুদয় অর্থ পাচার করেন। পাচার করা অর্থের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে রয়েছে।

দুদক সূত্রে জানা যায়, পি কে হালদারের অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত কানাডার বিভিন্ন হিসাবে জমা করা অর্থ ফ্রিজ (লেনদেন স্থগিত) করতে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। এখন মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

পি কে হালদার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদারের মাধ্যমে কানাডার বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডিয়ান ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮১ কোটি টাকা পাচার করেন। ওই অর্থ ফেরাতে কানাডায় মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে দুদক

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, আদালতের নির্দেশনার বিষয়টি আমিও শুনেছি। দুদক থেকে এমএলএআর পাঠানোর বিষয়টি আমার জানা নেই। এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো ফাইল বা নথি পাইনি। তাই বিস্তারিত বলতে পারছি না।

৮১ কোটি টাকা ফেরত আনতে কানাডায় মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠাবে দুদক / প্রতীকী ছবি

তবে, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পি কে হালদারের ঋণ কেলেঙ্কারি অনুসন্ধান ও তদন্তপর্যায়ে পাওয়া বিভিন্ন নথিপত্রের সূত্র ধরে দুদক অর্থ পাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে। পি কে হালদার তার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদারের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অর্থ লেনদেন করেছেন। এর প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।

প্রীতিশ কুমার হালদার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কানাডায় এক কোটি ১৭ লাখ কানাডিয়ান ডলারের বেশি অর্থ জমা করেছেন। যা প্রকৃত অর্থে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। কারণ, ওই টাকা পি কে হালদার অবৈধ প্রক্রিয়ায় পাঠিয়েছেন। এসবের প্রমাণও আমাদের হাতে রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা আদালতের রায়ের মাধ্যমে ফ্রিজ করার নির্দেশনা পেয়েছি। তদন্তের স্বার্থে এখন কানাডায় জমা করা অর্থ যত দ্রুত সম্ভব ফ্রিজ করা প্রয়োজন। না হলে অর্থ বেহাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে— বলেন ওই কর্মকর্তা।

কখন কীভাবে অর্থপাচার

অর্থপাচারের বিষয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আলোচিত পি কে হালদার তার ভাই প্রীতিশের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ৮০ কোটি ৯২ লাখ ৪১ হাজার ৫০২ টাকা অর্থাৎ এক কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডিয়ান ডলার পাচার করেন।

এর মধ্যে ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত প্রীতিশ কুমার হালদারের হিসাব থেকে ৯৩ হাজার কানাডিয়ান ডলার ও পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার কানাডায় পাচার হয়।

২০১২ সালের ৫ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ইলেক্ট্রিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে তিন লাখ ২৪ হাজার ৯৮৫ কানাডিয়ান ডলার ও ১০ হাজার মার্কিন ডলার প্রীতিশ হালদারের হিসাব থেকে কানাডায় পাঠানো হয়।

জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে (আনকাক) সই করা দেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে এমএলএআর ব্যবহৃত হয় / প্রতীকী ছবি

২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১২ জুলাই পর্যন্ত সময়ে পিঅ্যান্ডএল হল হোল্ডিং ইন্টারন্যাশনাল নামক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে পাঠানো হয় ৭২ হাজার কানাডিয়ান ডলার।

২০১৪ সালের ৮ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কানাডার পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিংয়ের হিসাবে ২১ লাখ ৮২ হাজার ৪৩১ কানাডিয়ান ডলার ও ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৫৬৭ মার্কিন ডলার পাঠানো হয়।

একই ভাবে ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত সময়ে পজ হোল্ডিং ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৬৮৮ কানাডিয়ান ডলার এবং ২০১৩ সালের ৯ মে থেকে ২০২০ সালের ৫ মে পর্যন্ত আট লাখ ৫২ হাজার ৯২১ কানাডিয়ান ডলার কিউবিক ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে জমা করা হয়।

২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ৩ মার্চ পর্যন্ত কিউবিক ইন্টারন্যাশনালের নামে ২৮ লাখ ৫৪ হাজার ৩৭৬ কানাডিয়ান ডলার, ২৯ লাখ ১৪ হাজার ৭০৩ মার্কিন ডলার, ১০ লাখ ১ হাজার ৭৩০ ইউরো এবং ২৪ হাজার পাউন্ড পাঠানো হয়।

এমএলএআর কি

এমএলএআরের পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট। অভিযোগসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার এক ধরনের চিঠি বা আবেদন। একটি দেশের দায়িত্বশীল সংস্থা সুনির্দিষ্ট তথ্যের বিষয়ে জানতে অন্য দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কাছে আইনি প্রক্রিয়ায় এ ধরনের এমএলএআর প্রেরণ করে থাকে। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে (আনকাক) সই করা দেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে এমএলএআর বেশি ব্যবহৃত হয়। আগে বাংলাদেশ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে এমএলএআর পাঠানো হতো। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমএলএআর পাঠানো হয়।

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অর্থপাচার মামলা

২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। পরে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় এখন পর্যন্ত ৮৩ ব্যক্তির প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ আদালতের মাধ্যমে ফ্রিজ করেছে দুদক

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, প্রশান্ত কুমার হালদার বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ নিজ দখলে রেখেছেন। যা দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উক্ত অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ উৎস, প্রকৃতি, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, উৎস গোপন বা আড়াল করতে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তর করে মানিলন্ডারিং-সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন। এক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২), ৪ (৩) ধারায় অপরাধ করেছেন তিনি।

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আছে / প্রতীকী ছবি

দায়ের করা অন্যান্য মামলা

দুদক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে আরও একটি টিম পি কে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। ওই টিম এরই মধ্যে ১৫টি মামলা করেছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানের ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা এবং ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’র ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করেছে দুদক।

অর্থপাচারের আরও যেসব অভিযোগ

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় এখন পর্যন্ত ৮৩ ব্যক্তির প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ আদালতের মাধ্যমে ফ্রিজ করেছে দুদক।

রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকায় পি কে হালদারের সাড়ে ৪০০ শতক জমি ও ধানমন্ডির দুটি ফ্ল্যাট জব্দ করেছে দুদক। এছাড়া রাজধানীর উত্তরায় একটি ১০ তলা ভবন ছাড়াও রাজধানীর গ্রিন রোড, উত্তরা, দিয়াবাড়ি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় থাকা পি কে হালদারের বিপুল পরিমাণ জমি জব্দের আদেশ এসেছে। পর্যায়ক্রমে তিন ধাপে এখন পর্যন্ত ৫২ আসামি ও অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। তার কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আরএম/ওএফ/এমএআর/