ফাইজারের করোনা ভ্যাকসিন | ফাইল ছবি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে ‘কোভ্যাক্স’ থেকে ফাইজারের টিকা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এর সংরক্ষণ ও পরিবহনের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কারণ এটি সংরক্ষণে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন...

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জরুরিভিত্তিতে অনুমোদন পাওয়া টিকাগুলোর অন্যতম ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা। এটি যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও জার্মানির জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কানাডা, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুরসহ বেশকয়েকটি দেশ টিকাটির অনুমোদন দিয়েছে।

বাংলাদেশও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে ‘কোভ্যাক্স’ থেকে ফাইজারের টিকা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে এ টিকা আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। এ অবস্থায় ফাইজারের টিকা আসলেও দেশে এর সংরক্ষণ ও পরিবহনের সক্ষমতা নিয়ে রয়েছে সংশয়। খোদ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে ফাইজারের টিকা | ফাইল ছবি

ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। মডার্নার ক্ষেত্রে তা মাইনাস ২০ ডিগ্রি। মাইনাস ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে বাংলাদেশের কিছুটা সক্ষমতা থাকবে। কিন্তু মাইনাস ৭০ ডিগ্রির ক্ষেত্রে একেবারেই সক্ষমতা নেই

তাদের দাবি, ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। মডার্নার ক্ষেত্রে তা মাইনাস ২০ ডিগ্রি। মাইনাস ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে বাংলাদেশের কিছুটা সক্ষমতা থাকবে। কিন্তু মাইনাস ৭০ ডিগ্রির ক্ষেত্রে একেবারেই সক্ষমতা নেই।

ফাইজারের টিকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এ টিকা যে তাপমাত্রায় রাখতে হয়, সেই তাপমাত্রায় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কোনো সুবিধা নেই। এটা তো গণহারে টিকা দেওয়ার বিষয়, অভ্যন্তরীণ হলে অন্য কথা ছিল

আইইডিসিআর ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন

এ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ফাইজারের টিকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এ টিকা যে তাপমাত্রায় রাখতে হয়, সেই তাপমাত্রায় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কোনো সুবিধা নেই। এটা তো গণহারে টিকা দেওয়ার বিষয়, অভ্যন্তরীণ হলে অন্য কথা ছিল।’

আইইডিসিআর ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন | ফাইল ছবি

তিনি বলেন, ‘ফাইজারের টিকার বৈশিষ্ট্য হলো- এটার জেনেটিক কোড শরীরের ভেতর ঢুকানোর জন্য চর্বিজাতীয় একটা আবরণ ব্যবহার করে। এখন এ চর্বির আবরণটা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গলে যাবে। এটিকে অতিশীতল তাপমাত্রায় রাখলে চর্বির আবরণটা যথাযথ থাকবে। এজন্য এটাকে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে।’

বাংলাদেশের পরিবেশে এটি কতটুকু কার্যকর হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ফাইজারের টিকা সব জায়গাতে কার্যকর। ট্রায়ালে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর এটি। সুতরাং আশা করা যায় বাংলাদেশেও এটি কার্যকর হবে।’

আমরা কোভ্যাক্সের টিকার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। টিকা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

কবে নাগাদ ফাইজারের টিকা আসতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারকে প্রথমে এ টিকা আনার ব্যাপারে অনুমোদন দিতে হবে। তবে প্রাইভেট বেশকয়েকটি প্রতিষ্ঠান এটা আনার বিষয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের নিয়মগুলো অনুসরণ করে কেউ আনতে চাইলে অবশ্যই আনতে পারবে। তবে প্রথম ধাপে সরকার বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান যেই আনুক, সরকার সেটা কিনে নেবে। কারণ প্রথম ধাপে যাদের দেওয়ার কথা, তাদের না দিয়ে খোলাবাজারে কোনো টিকা চালুর কোনো নীতি নাই। যারা আনবে, সরকার থাদের থেকে যথাযথ মূল্য দিয়ে কিনে নেবে। ফাইজারের টিকা মার্কিন ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা- এফডিএ, ইংল্যান্ডের পাশাপাশি স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারল্যান্ডে অনুমোদন দিয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে এখনও অনুমোদন দেয়নি। হয়তো তারা শিগগিরই অনুমতি দিয়ে দেবে, তখন বাংলাদেশে আনার ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা | ফাইল ছবি

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. লায়লা খালেদ বলেন, ‘ফাইজারের টিকা সংরক্ষণে যে তাপমাত্রা প্রয়োজন তেমন কোনো সক্ষমতা বাংলাদেশের হাসপাতাল কিংবা হেলথ সেন্টারগুলোতে নাই। কিছু ফ্রিজ কিনে এনে ঢাকায় এর স্টোরেজ করলেও মফস্বল এলাকায় সেটির পরিবহন এবং সংরক্ষণ কীভাবে হবে, সে বিষয়টি আগে ঠিক করতে হবে।’

ফাইজারের টিকা সংরক্ষণে যে তাপমাত্রা প্রয়োজন তেমন কোনো সক্ষমতা বাংলাদেশের হাসপাতাল কিংবা হেলথ সেন্টারগুলোতে নাই। কিছু ফ্রিজ কিনে এনে ঢাকায় এর স্টোরেজ করলেও মফস্বল এলাকায় সেটির পরিবহন এবং সংরক্ষণ কীভাবে হবে, সে বিষয়টি আগে ঠিক করতে হবে

অধ্যাপক ড. লায়লা খালেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কোভিড-১৯ টিকা সম্পর্কে অবগত নয়।’

ড. লায়লা খালেদ বলেন, ‘এ টিকা দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে দেয়া উচিত। টিকার জন্য দাম নির্ধারণ করলে বেশিরভাগ মানুষ সেটি গ্রহণ করবে না। আর যদি বড় জনগোষ্ঠীকে আমরা যদি টিকা আওতায় আনতে না পারি তাহলে এ রোগ নির্মূল হবে না।’

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ঢাকা পোস্টকে জানান, যেসব দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে টিকা নেবে তাদের কোভ্যাক্স একটি চিঠি পাঠিয়েছে। যেহেতু এটার কোল্ড চেইনটাই অন্যরকম, এটা নিয়ে বাংলাদেশ আগ্রহী বা প্রস্তুত কি-না, আমরা ফাইজার-বায়োএনটেকের এ টিকা নিতে চাই কি-না, তা ১৮ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে বলেছে।

ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন এমন বিশেষ রেফ্রিজারেটর | ফাইল ছবি

তিনি বলেন, আমরা কোভ্যাক্সের টিকার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। টিকা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেকের যৌথ উন্নয়নে তৈরি করা এ টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। এ তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণের জন্য বিশ্বের সেরা হাসপাতাগুলোতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই

কিছুদিন আগেই ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি করোনা ভাইরাসের টিকার অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাজ্য। এ টিকার জন্য নতুন করে রেফ্রিজারেটরও উৎপাদন করেছে দেশটি। সেখানেই সংরক্ষণ করা হবে এ টিকা। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, তারা ৫৮টি বিশেষায়িত টুইন গার্ড ফ্রিজের ব্যবস্থা করেছে। ফ্রিজগুলোতে প্রায় ৫০ লাখ ডোজ টিকা সংরক্ষণ করা যাবে। তবে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফাইজারের টিকা রাখার পরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেকের যৌথ উন্নয়নে তৈরি করা এ টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। এ তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণের জন্য বিশ্বের সেরা হাসপাতাগুলোতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। মূলত সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং করোনার টিকা সংরক্ষণ করতে নতুন রেফ্রিজারেটর উৎপাদন শুরু করেছে যুক্তরাজ্য।

সরবরাহ কেন্দ্র থেকে টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত টিকাটি মাত্র চারবার শীতলীকরণ ব্যবস্থা থেকে বের করা যাবে। নতুন এ ফ্রিজগুলো বহণযোগ্য নয়। প্রতিটি ফ্রিজে ৮৬ হাজার ডোজ টিকা রাখা যাবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশকে কোভ্যাক্সের চিঠি

গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ ১৯২টি সদস্যদেশকে চিঠি দিয়েছে কোভ্যাক্স। কোভ্যাক্সের পক্ষে চিঠিগুলো দিয়েছেন গ্যাভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ বার্কলি।

দ্বিতীয় ধাপে দেশের করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সামনে এর সংক্রমণ বাড়তে পারে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা | ফাইল ছবি 

চিঠিতে বলা হয়েছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ বা ফেব্রুয়ারিতে কোভ্যাক্সের উদ্যোগ থেকে স্বল্পসংখ্যক টিকা দেওয়া হবে। তারা বলছে, এটা টিকা বিতরণের ‘প্রথম ঢেউ’। টিকা পাওয়ার জন্য কিছু শর্তও দেওয়া হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ওষুধ কোম্পানি ফাইজার এবং যেসব দেশ ফাইজারের টিকা সংগ্রহ করেছে, তাদের সঙ্গে কোভ্যাক্সের আলাপ-আলোচনা চলছে। তার ভিত্তিতে কোভ্যাক্স জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বা ফেব্রুয়ারিতে সদস্যদেশগুলোকে টিকা দিতে পারবে।

চিঠিতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে

এ টিকা ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে, জাতীয় করোনা টিকা পরিকল্পনায় একাধিক ধরনের টিকা ব্যবহারের ইচ্ছার প্রকাশ থাকতে হবে। এছাড়া ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফাইজারের টিকার অনুমোদন করাতে হবে। তার সঙ্গে ফাইজারের দায়মুক্তির একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে।

চিঠিতে কিছু সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৮ জানুয়ারির মধ্যে সদস্যদেশগুলোকে আগ্রহের বিষয়টি কোভ্যাক্সকে জানাতে হবে। ১৯ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ বা গ্যাভি সংশ্লিষ্ট দেশের আগ্রহপত্র ও অবকাঠামো পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবে। তারা ২৯ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ঢেউয়ের টিকা বিতরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে এবং সদস্যদেশগুলোকে জানিয়ে দেবে।

ধনী দেশগুলোর প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বান

দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে করোনার ভ্যাকসিন কেনা বন্ধের জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, ধনী দেশগুলো কয়েকটি ভ্যাকসিনের বেশিরভাগ সরবরাহ কিনে নিয়েছে। আমি আহ্বান জানাচ্ছি, যারা বেশি ভ্যাকসিন কিনে নিয়েছেন তারা যাতে কোভ্যাক্সের জন্য এগুলো দান করে। সেই সঙ্গে আমি আরও আহ্বান জানাচ্ছি যে, ধনী দেশগুলো করোনা ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করা বন্ধ করে।

সবার জন্য টিকা নিশ্চিতকরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে গৃহীত উদ্যোগ ‘কোভ্যাক্স’। কোভ্যাক্স উদ্যোগের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে ২০০ কোটি ডোজ নিরাপদ ও কার্যকর টিকা সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

টিআই/এমএআর