করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুহার বাংলাদেশে দিনদিন বাড়ছে। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে গত ১০ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত ১০ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে।

এ অবস্থায় শিগগিরই প্রসূতিদের টিকার আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রসূতিদের ক্ষেত্রে শুধু টিকার অনুমোদন নয়, টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারও দিতে হবে। বিষয়টিকে যৌক্তিক বলে দাবি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভাবস্থায় নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই যেকোনো ফ্লু কিংবা সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার বুক ও পেটের মাঝের ডায়াফ্রাম নামক পর্দাটিও এসময় একটু উপরের দিকে উঠে যায় বলে স্বাভাবিকভাবেই শ্বাসকষ্ট হয়। করোনা সংক্রমণে সাধারণ মানুষের তুলনায় গর্ভবতী নারীর শ্বাসকষ্ট বেশি হতে পারে। তাই করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করার আশঙ্কা বেশি থাকে।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কো-মর্বিডিটি থাকা (বিভিন্ন পার্শ্ব অসুখ) গর্ভবতী নারীদের টিকার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে। পাশাপাশি যাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল তাদের ক্ষেত্রেও টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

গর্ভবতীদের অগ্রাধিকার দিয়ে অনুপ্রাণিত করা উচিত : সৈয়দ আতিকুল হক

প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও রিউমাটোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রসূতিকালীন সময়টাকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করি। এর প্রতিটিকে বলা হয় একেকটি ট্রাইমেস্টার (তিন মাসে এক ট্রাইমেস্টার)। দেখা গেছে, তৃতীয় ট্রাইমেস্টার পর্যায়ে কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হয়, তাহলে তার করোনা সহজেই তীব্র আকার ধারণ করে। আমরা গত কয়েকদিনে বেশ কিছু প্রসূতি মাকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি। এজন্য ভালো একটা ব্যবস্থা হতে পারে প্রসূতিদের টিকাদান।

এ ব্যাপারে পৃথিবীতে বেশকিছু গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। গত ১২ জুলাই ইসরাইলে একটি গবেষণার ফল প্রকাশ হয়েছে যেখানে করোনা টিকা দেওয়া প্রায় সাত হাজার ৫০০ জন এবং টিকা না দেওয়া সাত হাজার ৫০০ জন গর্ভবতী মায়ের ফলাফল দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, যারা টিকা নেননি তাদের মধ্যে ফলাফলটা অনেক খারাপ ছিল।

প্রসূতি মায়েদের টিটেনাস টিকা দিতে বলা হয় দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের শেষ ভাগে। কারণ তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যখন সে সন্তান জন্ম দেবে, তখন কখনো কখনো টিটেনাসে আক্রান্ত হতে পারে। এটা আমাদের অনুমোদন রয়েছে। ঠিক তেমনি প্রসূতি মায়েদের যদি করোনা মহামারি চলাকালীন সময়ে করোনা টিকা দেওয়া হয়, এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো এবং পৃথিবীর অনেক দেশে গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, আমাদের দেশেও এটি করা উচিত।

গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফাইজার টিকার বিষয়ে একাধিক গবেষণার মাধ্যমে নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। অন্যান্য টিকা নিয়ে আমরা বলতে পারি, গর্ভবতী অবস্থায় হয়তো তেমন গবেষণার ফলাফল নেই। অনেক সময় ফলাফল ছাড়াও কিন্তু যৌক্তিক বিশ্লেষণটাকে প্রাধান্য দিই আমরা।

এই যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখব, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গ্রুপে গত ২২ ডিসেম্বর টিকা সংক্রান্ত একটি  নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে তারা লিখেছিল, দুটি টিকা গর্ভবতী মায়েদের দিতেই হবে। তার একটি হলো ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা। যদি তার গর্ভকালীন সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার সিজন চলে আসে, যেমন আমেরিকায় অক্টোবর মাসে যদি কেউ গর্ভবতী হন তাকে এ টিকা নিতে অনুপ্রাণিত করা হয়। আরেকটা হচ্ছে টিটেনাস ডিপথেরিয়া, এটাও দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের শেষভাগে দিতে হয়। এগুলো শুধু অনুমোদিত নয়, এগুলোতে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে।

আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় হলো, ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকাটি যে প্লাটফর্মে তৈরি, আমাদের দেশে সিনোফার্মের যে টিকাটি এসেছে, সেটিও কিন্তু একই প্লাটফর্মে তৈরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেই নির্দেশিকার উপসংহারটা ছিল এ রকম- যেহেতু এই প্ল্যাটফর্মের টিকাগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্য গর্ভবতীদের শরীরে ব্যবহার করা হচ্ছে, এমনকি তাদের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সুতরাং এর থেকে আমরা সার্বিকভাবে বলতে পারি, আমাদের করোনার টিকাগুলো গর্ভবতীদের জন্য ঝুঁকি আনবে না। যদি কিছুটা থাকেও, তাহলে ঝুঁকির চেয়ে উপকারের মাত্রাটা বেশি হবে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ধাত্রীবিদ্যা কাউন্সিলও (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনোকলজি অ্যান্ড অবসটেট্রিকস) জোর দিয়ে বলছে, গর্ভবতীদের জন্য টিকা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। কাজেই আমি বলব, সরকার বাধ্যতামূলক না করুক, অন্তত গর্ভবতীদের অগ্রাধিকারে আনা দরকার। বয়স ৩০ বছরের নিচে হলেও তাদের টিকা দেওয়া হোক। এক্ষেত্রে গর্ভবতীদের অনুপ্রাণিতও করা দরকার।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রোধে টিকার বিকল্প নেই : অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম

বিশিষ্ট গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম বলেন, কোভিডের শুরুতে ফার্টিলিটি সোসাইটিগুলো এক অজানা আশঙ্কায় চিকিৎসা বন্ধ রাখতে বলেছিল। কারণ প্রেগন্যান্সিতে মায়ের ও বাচ্চার ওপর কোভিডের প্রভাব ছিল অজানা। কিন্তু ইংল্যান্ডের একটি বড় সমীক্ষায় দেখা গেল, রিস্ক ফ্যাক্টর যেমন : ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ থাকা (বিশেষ করে ব্ল্যাক এবং এশিয়ানদের মধ্যে) মায়েদের মৃত্যুহার বেশি। যা নন-প্রেগন্যান্টদের জন্যও প্রযোজ্য। প্রিম্যাচিউরড ডেলিভারি ছাড়া বাচ্চাদের উপর তেমন কোনো প্রভাব নেই। বিশেষ করে জন্মগত ত্রুটির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। মায়ের প্রিএকলাম্পসিয়া এবং ইনট্রাইউটেরাইন ফিটাল ডেথের ঝুঁকি বেশি থাকে।

তিনি বলেন, করোনাকাল দীর্ঘ হতে থাকায় এবং ‘অসহনীয় ঝুঁকি’ নেই বলে পরবর্তীতে সব চিকিৎসা শুরু করা হলো। আমাদের দেশেও আমরা সেরকম উপলব্ধি করেছি। কিন্তু এবারের ভ্যারিয়েন্ট আলাদা। মায়ের রিস্ক ফ্যাক্টর থাক বা না থাক, অবস্থা জটিল। তাই প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। শুধু নিজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই প্রটেক্টেড থাকা যাচ্ছে না। অতএব ভ্যাক্সিনেশনের বিকল্প নেই। যত তাড়াতাড়ি মানুষ ভ্যাক্সিনেটেড হবে ততই করোনা বিলুপ্তির সম্ভাবনা বাড়বে। তখনই এলো গর্ভাবস্থায় ভ্যাক্সিনেশন প্রসঙ্গ। গর্ভাবস্থায় টিকা নেওয়া যাবে নাকি যাবে না? ফাইজার এবং মডার্নার টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেছে সব বড় বড় সংস্থাগুলো। এ পর্যন্ত যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের বাচ্চাদের কোনো জন্মগত ত্রুটি পাওয়া যায়নি। আমেরিকায় এক লাখেরও বেশি টিকাপ্রাপ্ত গর্ভবতীদের এবং তাদের বাচ্চাদের মধ্যে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।

রাশিদা বেগম বলেন, অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ব্যাপারে বলা হয়েছে, যারা কোভিড ইনফেকশনের জন্য উচ্চ ঝুঁকিতে আছে তারা নিতে পারবে। যেমন : স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িত সবাই। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল যে, প্রয়োজনে নিতে পারবে। বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে নিতে হবে। অশনাক্ত গর্ভাবস্থায় এই ভ্যাক্সিন দিয়েও পরবর্তীতে বাচ্চার কোনো অসুবিধা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ গর্ভাবস্থার প্রথম দিকেও টিকা দিলে অসুবিধা নেই। সিনোভ্যাকও নেওয়া যাবে।

তিনি আরও বলেন, এক ডোজ নেওয়ার পরে প্রেগন্যান্ট হলে যথা সময়ে পরবর্তী ডোজ নিতে হবে। প্রেগন্যান্সির যে কোনো সময়ে নেওয়া যাবে, তবে ১৪ সপ্তাহ থেকে ৩৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সুপারিশ করেছে কেউ কেউ। অন্তত প্রথম ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত না দিতে পারলে ভালো। যদিও যারা ফাস্ট ট্রাইমেস্টারে (১২ সপ্তাহ) নিয়েছে তাদের মধ্যেও কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। বরং টিকাপ্রাপ্ত নারীদের ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানদের শরীরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যা টিকার আরেকটি ইতিবাচক দিক।

একটু বেশি সতর্কতার জন্য কিছু সাজেশন অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন :  যাদের দুটো সন্তান আছে, তারা একটি কার্যকরী জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যাদের বয়স ৩০ এর নিচে, তাদের প্রথম হোক বা দ্বিতীয় সন্তান হোক, হয় আরও কিছুদিন জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিন অথবা দুই ডোজ টিকা শেষ করে বাচ্চা নিন। ইনফার্টাইল পেশেন্ট যাদের বাচ্চা না হবার কারণ পিসিও এবং বয়স ৩০ এর নিচে, তারা নিশ্চিন্তে এই কোভিড সময় শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন। এই সময়ে ওসিপি খেলে জন্মনিয়ন্ত্রণও হবে, পিসিও এর সমস্যারও কিছু সমাধান হবে। যদি অপেক্ষা না করতে চান, বাচ্চা নেওয়ার আগে টিকা নিয়ে নিন।

বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, টিকার বিষয়ে সর্বোপরি বলা যায়, আগে ভ্যাক্সিন নিন, পরে বাচ্চা নিন। যদি আগে বাচ্চা এসেই যায়, নিঃসংকোচে টিকা নিন। প্রেগন্যান্সির যে কোনো সময় টিকা নেওয়া যাবে। তবে প্রথম ১২ সপ্তাহে না নেওয়াই ভালো। ব্রেস্ট ফিডিংয়ের সময়ও টিকা নেওয়া যাবে।

করোনা আক্রান্ত হলে প্রসূতি ও বাচ্চা উভয়েরই ঝুঁকি : ডা. শাহরিয়ার রোজেন

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশনের (সিআরআইডিএ) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাহরিয়ার রোজেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ কথা সত্য যে, এখন পর্যন্ত গর্ভবতী নারী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের ওপর বড় পরিসরে কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়নি। তবে বিগত সাত মাসে বিশ্বজুড়ে প্রচুর সংখ্যক গর্ভবতী এবং দুগ্ধবতী মা কোনো রকম তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই টিকা গ্রহণ করেছেন।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে একটি গবেষণায় গর্ভবতী নারীদের ওপর এম-আরএনএ (ফাইজার বা মডার্না) ভ্যাকসিন নিরাপদ হওয়ার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছ। ৩৫০০০ গর্ভবতী নারী এম-আরএনএ (ফাইজার বা মডার্না) ভ্যাকসিন গ্রহণের পর তাদের সন্তান ধারণ ক্ষমতা অথবা নবজাতক শিশুর বিকাশের ওপর কোনো প্রকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বাংলাদেশেও এখন এম-আরএনএ (ফাইজার বা মডার্না) ভ্যাকসিন আসা শুরু হয়েছে।

শাহরিয়ার রোজেন বলেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গর্ভবতী নারীদের এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের ফাইজার এবং মডার্নার টিকা প্রদান করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসির মতো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান গর্ভবতী নারী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের টিকায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মত দিয়েছে। সম্প্রতি ভারত করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য গর্ভবতী নারীদের টিকা দেওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বিপজ্জনক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রাধান্য বিস্তার করায় এবং ব্যাপকহারে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় দেশে আগের চেয়ে বেশি গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারী করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মৃত্যুবরণ করছেন। আগামী দিনগুলোয় অনেক বেশি সংখ্যক গর্ভবতী নারী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েরা করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। গর্ভবতী নারী করোনায় সংক্রমিত হলে মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এ কারণে অনতিবিলম্বে গর্ভবতী নারীদের এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের ফাইজার বা মডার্না টিকার আওতায় আনা উচিত।

প্রসূতিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাই ঝুঁকি বেশি : ডা. কাকলী হালদার

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে গর্ভবতী নারীদের। তাই অনতিবিলম্বে আমাদের দেশে গর্ভবতী মায়েদের জন্য কোভিড-১৯ টিকা চালু করা দরকার। প্রথম সারির কোভিড-১৯ নারীযোদ্ধা যেমন- ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সংবাদকর্মীরা নিজের এবং গর্ভের শিশুর জীবন বিপন্ন করে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন গর্ভবতী নারী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে চিকিৎসকও রয়েছেন।

তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও আগেই গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মায়েদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী মায়েদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুহারও বেশি। মৃত্যু ছাড়াও মায়ের এবং গর্ভের শিশুর আরও অনেক রকম জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে।

পূর্বের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট এক্ষেত্রে বেশি সংক্রামক এবং ঝুঁকিপূর্ণ বলেই গর্ভবতী নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এই অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) গর্ভবতী নারীদের টিকা দেওয়ার জন্য আরও আগেই অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের দেশেও অনতিবিলম্বে শুরু করা উচিত। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা এবং মৃত্যুহার দুটোই কমবে। গবেষণা ও পরিসংখ্যান সেটাই বলছে।

গর্ভবতী মায়েদের কোভিড-১৯ টিকা দিলে বাচ্চা এবং মায়ের (ভ্যাকসিন পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বাদে) কোনোরকম ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সব ধরনের কোভিড-১৯ টিকা গর্ভের যে কোনো সময় (তবে গর্ভের ১৪-৩৩ সপ্তাহের মধ্যে নিতে পারলে বেশি ভালো) নিতে পারবেন। টিকা দিলে মায়ের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে তা রক্তের মাধ্যমে গর্ভের শিশুর শরীরে যাবে এবং করোনাভাইরাস আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে।

কর্তৃপক্ষের অবস্থান কী?

গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের টিকাদানের বিষয়ে বাংলাদেশে এখনো কোনো সিদ্ধান্ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর খবর আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। যেহেতু গর্ভবতী মায়েদের টিকার বিষয়ে বিশ্বের কোথাও বড় ধরনের কোনো গবেষণা হয়নি, তাই এ বিষয়টি নিয়ে কিছুটা জটিলতা রয়েছে। আমরা আশা করছি, দুই একদিনের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারব।

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, প্রসূতি মায়েদের টিকা প্রয়োগ নিয়ে উৎপাদন কমিটির সিদ্ধান্তই যথেষ্ট নয়। টিকার পরীক্ষায় গর্ভবতী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে চাইলে যেকোনো দেশের কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর পরামর্শক কমিটির সঙ্গে আলোচনা করছে। যেহেতু গর্ভবতী মায়েদের টিকা প্রয়োগে এখনো বড় পরিসরে কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি, তাই স্বাস্থ্য অধিদফতর এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

তিনি বলেন, আমার ব্যক্তিগত মত হলো, যেকোনো ফ্রন্টলাইনার গর্ভবতী নারীকে টিকা দেওয়া উচিত। কর্তৃপক্ষ চাইলেই প্রসূতিদের টিকা দেওয়া যেতে পারে।’  
 
প্রসূতিদের টিকা নিয়ে ফগসির ১৩ সুপারিশ

এদিকে প্রসূতিদের টিকার বিষয়ে ফেডারেশন অব অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গায়নাকোলজিক্যাল সোসাইটিজ অব ইন্ডিয়া (ফগসি) গত ২৩ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। সেগুলো হলো :

১. নারীরা মাসিকের যেকোনো দিন কোভিড টিকা নিতে পারবেন।

২. টিকা নেওয়ার আগে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করার দরকার নেই।

৩. বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও টিকা নিতে পারবেন। এতে ফার্টিলিটি রেটে কোনো সমস্যা করে না বা বাচ্চাও নষ্ট করে না।

৪. অপারেশনের তারিখ সামনে থাকলে টিকা অপারেশনের পর দেওয়া ভালো।

৫. প্রেগন্যান্সিতে কোভিড টিকা দিতে গেলে চিন্তা হলো, টিকা দেওয়ার পরে বাচ্চার কোভিড হবে কি না? এ চিন্তার যৌক্তিক ভিত্তি নেই। কোনো মায়ের কোভিড হলেও ইনফেকশন মা থেকে বাচ্চার শরীরে যাওয়াটা বিরল। আর বাচ্চার যদি হয়ও খারাপ কিছু হয় না বলেই এখন পর্যন্ত তথ্য মেলে।

৬. কোভিড টিকা দিলে গর্ভের বাচ্চার জন্মগত কোনো ত্রুটি হয় এ রকম কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

৭. যদি প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাসে টিকা দেওয়া হয় তাহলে বাচ্চার কোনো জন্মগত ত্রুটি হয় না এবং টিকা দেওয়ার কারণে কোনো রকম গর্ভপাত করার দরকার নেই। কেউ চাইলে প্রথম তিন মাসেই টিকা দিতে পারে। তবে, কেউ চাইলে প্রথম তিন মাস এড়িয়ে যেতে পারেন।

৮. টিকার কারণে মায়ের রক্ত জমাট বাঁধার হারও বাড়ে না। তবে প্রেগন্যান্সি ও প্রসব পরবর্তী সময়ে এমনিতেই রক্ত একটু ঘন হয়। সে কারণে কোভিড হলে অন্যান্য সময়ের তুলনায় ১০ গুণ বেশি রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।

৯. সব প্রেগন্যান্ট রোগীকে টিকা দেওয়ার সুপারিশ করতে হবে। বিশেষ করে হাইরিস্কে যারা আছেন তাদের অবশ্যই টিকা দেওয়া উচিত সবার আগে।

১০. সাধারণত টিকা দেওয়ার পরে হালকা জ্বর হয়। সমস্যা হলে তাদের সে অনুযায়ী ওষুধ দিতে হবে। জটিল কোনো সমস্যা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

১১. প্রেগন্যান্সির শেষ তিন মাসেও টিকা দেওয়া যাবে। কিন্তু ডেলিভারি যদি কয়েকদিনের মধ্যে হবে বলে মনে হয়, তাহলে সেই সময়টা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

১২. ডেলিভারির পরে যেকোনো দিন টিকা দিতে পারবে। এমনকি হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার আগেও সে টিকা দিয়ে যেতে পারে। এতে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে কোনো সমস্যা হবে না।

১৩. যেসব গর্ভবতীর অন্যান্য রোগ আছে, তারা করোনার জন্য হাইরিস্ক এবং তাদের দ্রুত টিকার আওতায় আনতে হবে। তবে যাদের অন্য কোনো জটিলতা নেই তারা যে কোনো টিকা নিতে পারবেন।

টিআই/এসকেডি/জেএস