৪২তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা ১ হাজার ৯১৯ চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই আছেন বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, বিশেষ এ বিসিএস থেকে চার হাজার চিকিৎসকের জন্য সুপারিশ করা হলেও মোট পাঁচ হাজার ৯১৯ জনকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করেছে পিএসসি (বাংলাদেশ কর্ম কমিশন)। ১ হাজার ৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। যেহেতু তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে, সেহেতু নিশ্চয়ই তারা একটা প্রসেসিংয়ের (প্রক্রিয়া) মধ্যে আছেন।

বিশেষ বিসিএস থেকে চার হাজার চিকিৎসকের জন্য সুপারিশ করা হলেও মোট পাঁচ হাজার ৯১৯ জনকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে পিএসসি (বাংলাদেশ কর্ম কমিশন)। ১ হাজার ৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে

গতকাল মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) বিকেলে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপে এমন মন্তব্য করেন ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বিগত সময়ে বাংলাদেশে যেখানে সরকারি চিকিৎসক ছিলেন মাত্র আট হাজার ৩১২ জন, সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদে এখন দেশে ৩৬ হাজার সরকারি চিকিৎসক রয়েছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তিনি নতুন করে ছয় হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে পূর্ববর্তী বিসিএস থেকে দুই হাজার জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং ৪২তম বিসিএস থেকে চার হাজার জনকে সুপারিশ করা হয়েছে। বাকিদেরও আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হবে।

‘আমি মনে করি দেশে আরও বেশি চিকিৎসক দরকার। বাংলাদেশ এমন একটি জনপদ, যেখানে জনবসতির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে জনবলের কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে জনবল (চিকিৎসক) আরও বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ জরুরি।’

বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর দুই হাজার চিকিৎসককে ‘সহকারী সার্জন’ পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এরপর চলতি বছরের ৩০ জুন অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সভায় আরও চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগে সিদ্ধান্ত হয়। এ হিসাবে মোট ছয় হাজার চিকিৎসক নেওয়ার কথা। কিন্তু পরবর্তীতে ৭ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নবনিয়োগ শাখার এক বিজ্ঞপ্তিতে চার হাজারের পরিবর্তে দুই হাজার অতিরিক্ত চিকিৎসক নেওয়ার কথা জানানো হয়।

ফলে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ৪২তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলে মোট পাঁচ হাজার ৯১৯ জন উত্তীর্ণ হলেও পিএসসি চার হাজার জনকে ‘সহকারী সার্জন’ পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। অবশিষ্ট ১ হাজার ৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়। 

এর আগে ৩৩তম বিশেষ বিসিএসে দুই হাজার ৪০০ জনের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও সাড়ে ছয় হাজার জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। একইভাবে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসেও চার হাজার চিকিৎসকের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাড়ে ছয় হাজার জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ হিসাবে দুটি বিশেষ বিসিএস থেকেই অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অপেক্ষমাণ চিকিৎসকরা যা বলছেন

অপেক্ষমাণ চিকিৎসকরা বলছেন, শূন্য পদে তাদের নিয়োগ দিলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় তারা স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেবেন। এজন্য নিয়োগবঞ্চিতরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন।

ডা. এম এইচ মনিরুজ্জামান, ৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ কিন্তু অপেক্ষমাণ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা ডা. এম এইচ মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৪২তম বিসিএসে আমরা প্রায় সাড়ে ৩২ হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করি। এর মধ্যে চূড়ান্তভাবে পাস করি পাঁচ হাজার ৯১৯ জন। এর মধ্য চার হাজার জনকে সুপারিশ করা হয়েছে। এক হাজার ৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, পদের স্বল্পতার কারণে সুপারিশ করা যাচ্ছে না।

প্রকাশিত ৪২তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী মোট পাঁচ হাজার ৯১৯ জন উত্তীর্ণ হলেও পিএসসি পদের স্বল্পতার কারণে চার হাজার জনকে ‘সহকারী সার্জন’ পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। অবশিষ্ট এক হাজার ৯১৯ জনকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়

তিনি বলেন, আমরা যারা অপেক্ষমাণ তালিকায় আছি, আমরা জানি যে সবাই যথেষ্ট কোয়ালিফাইড। আমরা প্রিলিমিনারি ও ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়েই এখানে এসেছি। করোনার এ ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে জনগণের সেবায় নিয়োজিত হতে সর্বদা প্রস্তুত আমরা। দেশের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো প্রান্তে যদি আমাদের সুযোগ দেওয়া হয়, সেখানেই কাজ করতে প্রস্তুত।

মনিরুজ্জামান আরও বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আমরা যারা অপেক্ষমাণ তালিকায় আছি, আমাদের সুপারিশ করা হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারব। মুজিব বর্ষে স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সরকারের যে প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা, সেটা বাস্তবায়নে আমরা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারব।

ডা. এ টি এম আখেরুজ্জামান সুমন, ৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ কিন্তু অপেক্ষমাণ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ডা. এ টি এম আখেরুজ্জামান সুমন বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি উপজেলাপর্যায়ে চরম চিকিৎসক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য একজন চিকিৎসকের কথা বলছে, সেখানে আমাদের প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের জন্য রয়েছেন একজন চিকিৎসক। ফলে চিকিৎসক সংকট কাটিয়ে উঠে প্রান্তিকপর্যায়ে আমরা এখনও কার্যকরভাবে চিকিৎসাসেবা সর্বত্র পৌঁছে দিতে পারিনি।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা এবং প্রান্তিকপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ৪২তম বিসিএসের অপেক্ষমাণ এক হাজার ৯১৯ জনকে সুযোগ দিলে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারব।

ডা. ফারজানা সাথী বলেন, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর মহান জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, আমাদের চিকিৎসকদের জন্য ১১ হাজার ৩৬৪টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮তম বিসিএসের মাধ্যমে ২৯১ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ৪২তম বিসিএসের মাধ্যমে চার হাজার চিকিৎসকের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এরপরও আমরা দেখছি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আরও ছয় হাজারের অধিক পদ শূন্য রয়েছে।

 ডা. ফারজানা সাথী, ৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ কিন্তু অপেক্ষমাণ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী দেশে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকলেও ৪২তম বিসিএস থেকে এক হাজার ৯১৯ জনকে ‘পদ স্বল্পতার’ কারণ দেখিয়ে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। এটা আসলে কতটুকু যৌক্তিক আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা মনে করি, উত্তীর্ণ কিন্তু নিয়োগবঞ্চিত চিকিৎসকদের যদি নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে দেশের চিকিৎসক সংকট অনেকাংশে লাঘব হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের এইচআরআইএস রিপোর্টের (গত ৫ সেপ্টেম্বর) তথ্যানুযায়ী, শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের শূন্য পদ রয়েছে পাঁচ হাজার ৮৪৮টি। এদিকে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০২১ এর স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা অধ্যায়ের সূচক অনুযায়ী, দেশে চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাত হচ্ছে ১:১৭২৪। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার ৭২৪ জনের জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাত ১:১০০০ থাকা উচিত।

প্রান্তিকপর্যায়ে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে প্রস্তুত ৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ কিন্তু অপেক্ষমাণ চিকিৎসকরা / ফাইল ছবি

এসব প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশে অন্তত এক লাখ ৬০ হাজার চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের আছে এক লাখের মতো। এখন প্রতি হাজার মানুষের জন্য যদি আমরা একজন চিকিৎসক নেই, তাহলে আমাদের চিকিৎসক লাগবে আরও ৬০ হাজার। সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সরকারি চিকিৎসক প্রয়োজন ৬০ হাজার। কিন্তু দেশে সরকারি চিকিৎসক আছে মাত্র ৩৬ হাজার। তাই ঘাটতি পূরণে শিগগিরই আরও ২৪ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ জরুরি। এটি পূরণে ৪২তম বিসিএস থেকে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ কোনো বিষয় না।

তিনি আরও বলেন, সরকার হয়তো তাদের সবাইকে পর্যায়ক্রমে সুপারিশ করে নিয়োগ দেবে। আমি মনে করি, ৪২তম বিসিএস থেকে যেহেতু ছয় হাজার জনকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের সবাইকে যেন ধীরে ধীরে নিয়োগ দেওয়া হয়। করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে যাওয়ার কারণে যেন ভাবা না হয় যে চিকিৎসকদের প্রয়োজন নাই। 

‘চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টদের যেকোনো সময়ই প্রয়োজন হতে পারে। তাই আমি মনে করি, তাদের নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার উন্নয়নে উপজেলাপর্যায় পর্যন্ত যেন সব শূন্য পদ পূরণ করা হয়।’

টিআই/এমএআর/