ট্রাম্পের অভিশংসন: শুনানিতে যা বললেন ডেমোক্র্যাটরা
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প/ ছবি: সংগৃহীত
সিনেটে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন ডেমোক্র্যাটরা। এতে আগে দেখা যায়নি বা প্রকাশিত হয়নি এমন নতুন নতুন তথ্য, ছবি ও ভিডিও উপস্থাপন করেছেন তারা। আর এর মাধ্যমে গত ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে সমর্থকদের হামলার পেছনে ট্রাম্পের সরাসরি দায় রয়েছে বলে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার সময় বিভিন্ন সময় ট্রাম্পের দেওয়া বক্তব্য ও টুইট তার (ট্রাম্প) বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেন ডেমোক্র্যাটরা। এছাড়া ক্যাপিটল ভবনে হামলার ঘটনায় ট্রাম্পকে ‘প্রধান উস্কানিদাতা’ হিসেবেও উল্লেখ করেন তারা।
বিজ্ঞাপন
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ হলো, নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতি হয়েছে বলে ট্রাম্প একের পর এক প্রমাণহীন অভিযোগ দিতে থাকেন। কিন্তু তার ওই অভিযোগ ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। তারপর কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনের সময় ক্যাপিটল ভবনে যেতে সমর্থকদের উস্কানি দিয়েছেন ট্রাম্প। নির্বাচনে জালিয়াতির কথা শুনে সমর্থকরা আগে থেকেই উত্তেজিত ছিলেন। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল হামলার উস্কানি। এ কারণেই ক্যাপিটল ভবনে হামলা করে ট্রাম্প সমর্থকরা।
ডেমোক্র্যাটদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হওয়ায় এবার ট্রাম্পের আইনজীবী ও ইমপিচমেন্ট ম্যানেজাররা ১৬ ঘণ্টা সময় পাবেন তাদের কথা ও যুক্তি তুলে ধরার জন্য। দুই দিন ধরে তারা ট্রাম্পের সমর্থনে যাবতীয় যুক্তি উপস্থাপন করবেন।
বিজ্ঞাপন
সিনেটে অভিশংসন শুনানির সূচনা করে ডেমোক্র্যাট সদস্য জেমি রাসকিন বলেন, ট্রাম্পের এই বিচার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘সত্য প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত’। ট্রাম্পের আইনজীবীরা দাবি করেছিলেন- সাবেক এই প্রেসিডেন্ট নাকি ক্যাপিটলে হামলায় সমর্থকদের উস্কানি দেননি। কিন্তু রাসকিন বলেন, তথ্যপ্রমাণ দেখিয়ে দেবে, এই ঘটনায় ট্রাম্পের ভূমিকা কী ছিল। তিনি ‘কম্যান্ডার ইন চিফ’-এর বদলে ‘ইনসাইটার ইন চিফ বা ‘প্রধান উস্কানিদাতা’য় পরিণত হয়েছিলেন।
এরপর রাসকিন সেসময় ট্রাম্পের করা একের পর এক টুইট উদ্ধৃত করে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ট্রাম্পের আইনজীবীরা যা বলছেন, তা ঠিক নয়। ট্রাম্পের একটি টুইটে বলা হয়েছিল, ‘বি দেয়ার, উইল বি ওয়াইল্ড’, অর্থ্যাৎ ‘সেখানে (ক্যাপিটলে) অবস্থান করুন, হিংস্র হোন’। এরপর রাসকিন বলেন, এসবই দেখিয়ে দিচ্ছে, ক্যাপিটল হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের ভূমিকা কতখানি ছিল।
অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট সদস্য জো নেগুসে জানিয়েছেন, ট্রাম্পের উস্কানির ফলেই তার সমর্থকরা যে ক্যাপিটলে হামলা ও তাণ্ডব করেছিলেন, সেটা অভিশংসন ভাষণে তার দলের সদস্যরা প্রমাণ করে দেবেন। নির্বাচনে জালিয়াতি নিয়ে একের পর এক প্রমাণহীন কথা বলে, ট্রাম্প আগে থেকেই সমর্থকদের উত্তেজিত করে রেখেছিলেন।
ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট সদস্য স্ট্র্যাসি প্ল্যাসকেট জানিয়েছেন, ট্রাম্প আগে থেকেই সব বুঝতে পেরেছিলেন। তারপরেও তিনি ইচ্ছে করে সমর্থকদের উস্কানি দিয়েছিলেন। তিনি সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন। আর এরপরই তার সমর্থকরা সহিংস হয়েছে এবং ক্যাপিটল ভবনে হামলা-তাণ্ডব চালিয়েছে।
এদিকে ক্যাপিটল ভবনে হামলার দিন নিরাপত্তা ক্যামেরায় ধরা পড়া একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছেন প্ল্যাসকেট। সেখানে দেখা যাচ্ছে, উগ্রপন্থী সংগঠন প্রাউড বয়জের বেশ কিছু সদস্য ক্যাপিটল ভবনে ঢুকে জানলার কাচ ভাঙছে। তারপর তারা করিডোরে প্রবেশ করে। নিরাপত্তা রক্ষীদের ওপরও তারা আক্রমণ করে সরিয়ে দিচ্ছে। এতে আরও দেখা যায়, হামলার একপর্যায়ে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সসহ অন্যদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর হামলাকারীরা চিৎকার করে বলছে, ‘মাইক পেন্সকে মার’, ‘ন্যান্সি পেলোসিসহ যাকে হাতের কাছে পাবো, তাকেই মারবো’।
প্ল্যাসকেটের বক্তব্য, ট্রাম্প এই সব করার জন্যই সমর্থকদের পাঠিয়েছিলেন। হামলাকারীরা প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে বিশেষ করে টার্গেট করেছিল। তার অফিসে ঢুকে হামলাকারীরা ভাঙচুর করে। একজনের হাতে অস্ত্র ছিল। আইনপ্রণেতারা যখন নিরাপদ জায়গায় যাচ্ছিলেন, তখনই হামলাকারীরা ক্যাপিটলে ঢুকে পড়ে। মিনিটখানেক আগে তারা ঢুকতে পারলেই অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হতো।
এর আগে সিনেটে ট্রাম্পের অভিশংসন শুনানি চলবে কি না সে সিদ্ধান্ত নিতে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। ১০০ সদস্যের সিনেটে ৫৬-৪৪ ভোটে ট্রাম্পের অভিশংসন শুনানি অনুষ্ঠানের পক্ষে রায় দেওয়া হয়। ট্রাম্পের শুনানি হওয়ার পক্ষে ভোট দেন ৬ জন রিপাবলিকান সিনেটরও।
এদিকে ট্রাম্পের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে উভয়পক্ষকে প্রশ্ন করার সুযোগ পাবেন সিনেটররা। এরপর অভিশংসন ব্যবস্থাপকের (ইমপিচমেন্ট ম্যানেজার) এর ভূমিকায় থাকা ৯ জন ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা শুনানির স্বার্থে সাক্ষী ডাকা কিংবা পরোয়ানা জারির অনুরোধ জানিয়ে বিচারপর্ব দীর্ঘায়িত করবেন কি না তা অবশ্য এখনও নিশ্চিত নয়। তবে ট্রাম্প সিনেটে সাক্ষ্য দেবেন না বলে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিতে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প সমর্থকরা নিজের ইচ্ছাতেই হামলা চালিয়েছিল সিনেটে শুনানির আগে দাবি করেন তার আইনজীবীরা। এছাড়া সিনেটের এই শুনানিকে ‘রাজনৈতিক নাটক’ এবং ‘নির্লজ্জ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।
জো বাইডেনের ক্ষমতাগ্রহণের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতীক ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে সশস্ত্র হামলা ও সহিংসতা চালায় ট্রাম্প সমর্থকরা। এতে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত হয় পাঁচ জন। সমর্থকদের চালানো এই হামলায় ট্রাম্প উস্কানি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরপর গত ১৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হন ট্রাম্প। আর এর মাধ্যমে লজ্জার বিরল এক ইতিহাস গড়েন তিনি।
ট্রাম্পের ভাগ্য এখন ঝুলে আছে সিনেটের হাতে। মেয়াদ শেষ হওয়ায় সিনেটে অভিশংসিত হলেও হয়তো ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসবে না। তবে প্রার্থী হতে পারবেন না ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। সর্বশেষ নির্বাচনে পরাজয়ের পরই ট্রাম্প অবশ্য ২০২৪ সালের জন্য নিজের প্রার্থিতার কথা জানান দিয়ে রেখেছেন।
সূত্র: বিবিসি
টিএম