পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন

পূর্বসূরি ট্রাম্পকে নিয়ে নানা নাটকীয়তা ও সহিংসতা শেষে গত বিশ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমবার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ভাষণে বিশ্বকে শক্তিশালী এক বার্তা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ওই ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তার শাসনামলে খুবই অন্যরকম এক আমেরিকাকে দেখবে গোটা বিশ্ব।  

ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া ওই ভাষণে বাইডেন অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন। তুলে ধরেছেন তার নয়া পররাষ্ট্রনীতির রুপরেখাও। তিনি একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে তার পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। শব্দবন্ধটি হল ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’। যার অর্থ ‘আমেরিকা তার পূর্বের অবস্থানে ফিরে এসেছে’।  

পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন।  

যুক্তরাষ্ট্র আগামী চার বছরে কী করবে সে সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি ওই বক্তব্যে পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন।

যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের পথে ফেরানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বাইডেন 

জো বাইডেনের ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও বৈশ্বিক আস্থা পুনরুদ্ধারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তিনি অবশ্য আগে থেকেই এমনটা বলে আসছেন। বাইডেন খুব নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন যে, তার বিতর্কিত পূর্বসূরির শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র তার শক্তিশালী অবস্থান হারিয়েছে এবং তিনি এই অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

বহুপাক্ষিক কূটনীতি আর অন্যান্য দেশের সাথে কাজ করার দিকে মনোনিবেশ করবে বাইডেন প্রশাসন   

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এখন বহুপাক্ষিক কূটনীতি এবং আরও ইতিবাচক উপায়ে অন্যান্য দেশের সাথে কাজ করার দিকে আরও বেশি মনোনিবেশ করবে। তবে বাইডেন জোর দিয়ে এও বলেছেন, এটাকে কেউ যেন যুক্তরাষ্ট্রের নরম অবস্থান হিসেবে না নেয়। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যা চায় তা পাওয়ার জন্য কূটনীতিই সর্বোত্তম উপায়।

শপথ নেওয়ার পরপরই ট্রাম্পের নীতি বদলাতে বাইডেন একগুচ্ছ নির্বাহী আদেশ জারি করেন

জো বাইডেন বলেন, ‘বিশ্বের জন্য সঠিক উপায় বলেই যে শুধু আমরা আমাদের কূটনীতিকে কাজে লাগাবো ব্যাপারটা অবশ্য এমন নয়। আমরা এটা করি বা আমাদের এটা করতে হয় নিজেদের নগ্ন স্বার্থের কথা ভেবেই।’

গণতন্ত্র নিয়েও বাইডেনের অবস্থান এমন। আমেরিকার পরিচয় ও নীতি-নৈতিকতার মূল দিক হিসেবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া নিয়েও সবসময়ই নিজের জোরালো অবস্থান তুলে ধরেছেন বাইডেন। পূর্বসূরি 

আমেরিকানদের কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের কথা জানিয়েছেন বাইডেন

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের ফল মেনে না নেওয়া ও ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে বাইডেন বলেছেন, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার এই ‘লড়াই’ আগামীর বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে জোরালো করবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আরও জোর দিয়ে বলেছেন যে, তার প্রশাসন মার্কিন জনগণের পক্ষে কল্যাণকর হিসেবে বিবেচনা করে এমন বিষয়গুলোর কথা ভেবেই নিজেদের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করবে।

অনেক নীতি ডানপন্থী রিপাবলিকানদের পছন্দ না হওয়ায় ঘরেই বিরোধিতার মুখে পড়তে পারেন বাইডেন

বাইডেন ভাষণে বলেন, ‘পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রনীতির মধ্যে এখন আর স্পষ্টত কোন পার্থক্য নেই। বিদেশে আমাদের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ আমেরিকান কর্মজীবী পরিবারগুলোর কথা মাথায় রেখেই আমাদের নিতে হবে।’

অভ্যন্তরীণ যেসব নীতির ঘোষণা বাইডেন দিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন করাটা কঠিন হতে পারে। তিনি অভিবাসন নীতিতে আরও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, শরণার্থী গ্রহণের সংখ্যা বাড়ানো (প্রতি বছর ১৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার) এবং এলজিবিটিকিউ (সমকামীদের) অধিকার রক্ষার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এসব নীতি ডানপন্থী রিপাবলিকানদের মর্মে আঘাত করতে পারে। ফলে ঘরেই বিরোধিতার মুখে পড়তে পারেন তিনি।

রাশিয়ার কোনো আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্র আর বরদাস্ত করবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বাইডেন

বন্ধু এবং শত্রু

রুশ-মার্কিন সম্পর্ক প্রসঙ্গে বাইডেন বলেন, পুতিনকে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, পূর্বসূরির চেয়ে তিনি একদম আলাদা। রাশিয়ার কোনো আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্র আর বরদাস্ত করবে না। মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ, যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার হামলা, রাশিয়ার বিরোধী নেতাকে পুতিন সরকারের বিষপ্রয়োগে হত্যাচেষ্টার প্রসঙ্গও টেনেছেন তিনি।

রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির দুর্দশার কথা তুলে ধরে তাকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান বাইডেন। ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ দমন করতে রুশ সরকারের অপচেষ্টার’ নিন্দা জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন একে ‘যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর উদ্বেগের বিষয়’ হিসেবে তুলে ধরেন।

‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ দমন করতে রুশ সরকারের অপচেষ্টার’ নিন্দা জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন একে ‘যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর উদ্বেগের বিষয়’ হিসেবে তুলে ধরেন।

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে পুতিনের সঙ্গে কাজ করার সদিচ্ছার কথাও অবশ্য বাইডেন জানিয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশ ইতোমধ্যে যে ‘নিউ স্টার্ট’ নামক চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে সে কথাও উল্লেখ করেন তিনি। এতে করে আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের সংখ্যা আরও কমাবে। 

এটাও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেওয়া নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান। ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে ‘ইন্টারমেডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস’ (আইএএন) ও উন্মুক্ত আকাশ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। 

চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাইডেন

বাইডেন চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী’ হিসেবে বর্ণনা করার পাশপাশি ‘মানবাধিকার, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি ও বৈশ্বিক সরকারব্যবস্থায় চীনের আগ্রাসন ঠেকানোর’ প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তবে একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকার স্বার্থের কথা ভেবে’ তিনি বেইজিংয়ের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরিতে প্রস্তুত ছিলেন।

বাইডেন হয়তো পূর্বসূরি ট্রাম্পের ইরানের সঙ্গে চরম শত্রুভাবাপন্ন অবস্থান থেকে সরে আসতে চাচ্ছেন।  

মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে ‘ছায়াযুদ্ধে’ জড়িত হওয়ার প্রসঙ্গ ছাড়া বাইডেনের ভাষণে ইরানের বিষয়টি অনুপস্থিত থাকার মাধ্যমে তেহরান নিয়ে ওয়াশিংটনের অবস্থান কী হতে পারে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। বাইডেন হয়তো পূর্বসূরি ট্রাম্পের মতো ইরানের সঙ্গে চরম শত্রুভাবাপন্ন অবস্থান থেকে সরে আসতে চান।  

বাইডেন আরেকটি বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িত সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটকে যে কোন সহযোগিতা ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রধান দ্বন্দ্ব মূলত ইয়েমেন নিয়েই। এই ইয়েমেন যুদ্ধ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। 

বাইডেন তার ভাষণে বলেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইয়েমেনের জন্য বিশেষ একজন প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘসহ বিবদমান পক্ষের সঙ্গে কাজ করে এই সংঘাত নিরসনে কাজ করবেন। 

বাইডেন ট্রাম্প প্রশাসন থেকে তার প্রশাসনের বিস্তর ফারাকের বিষয়টি বিশ্বকে খুব ভালো করে দেখাতে চাইছেন। 

‘আমি ট্রাম্প নই’

পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রেসিডেন্টের প্রথম ভাষণে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন থেকে তার প্রশাসনের মধ্যে বিস্তর ফারাকের বিষয়টি বিশ্বকে খুব ভালো করে দেখাতে চাইছেন জো বাইডেন। 

ট্রাম্পের মাধ্যমে আমেরিকার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন পড়বে।

পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ট্রাম্প যা যা করেছেন, তা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন বাইডেন। ট্রাম্প প্রণীত প্রায় সব নীতি থেকেই ক্রমাগত সরে আসছেন তিনি। একইসঙ্গে যে মতাদর্শ থেকে ট্রাম্প এসব করেছেন সেসব মতাদর্শকে আক্রমণ করেও কথা বলেছেন। বাইডেন তার এই অবস্থানকে ‘আমেরিকার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুননির্মাণ’ ও ‘বিশ্বের সঙ্গে পুনরায় একজোট হয়ে কাজ করার’ মতো শব্দবন্ধ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে চলেছেন।   

বাইডেন তার ওই ভাষণে বলেন ‘(পূর্বসূরি ট্রাম্পের মাধ্যমে) আমেরিকার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন পড়বে। তবে এখন আমরা যা করতে যাচ্ছি তা হল এই ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নেওয়া।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে জো বাইডেন

অপরদিকে বাইডেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ফের আশ্বস্ত করেছেন যে, আমেরিকাকে অবিশ্বাস করার সময় এখন শেষ হয়েছে। ভঙ্গুর এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মেরামত ও তা স্থিতিশীল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে কী করবে এবং কীভাবে করবে এ নিয়ে তিনি তার একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরেছেন।

তবে মিত্র ও শত্রুদের নিয়ে বাইডেন ওয়াংশিটনের অবস্থান স্পষ্ট করলেও নীরব ছিল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাজ্য। তাই এখন সময়ই বলে দেবে যে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে মোড় নেয়। 

এএস