জাপান, যে দেশে করোনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মহত্যা
বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে জাপানে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জাপানের সংবাদমাধ্যমগুলোও প্রতিদিন করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বিষয়ক সংবাদ পরিবেশন করে, তবে এর পাশাপাশি প্রতিদিন দেশে কতসংখ্যক আত্মহত্যা হলো- সেই তথ্যও জানাতে হয় তাদের।
জাপানে মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০২০ সালের অক্টোবরের কথাই ধরা যাক— ওই মাসে জাপানে করোনায় প্রাণহানি ২ হাজার ৮৭, অন্যদিকে আত্মহত্যার ঘটনা ২ হাজার ১১৯ এবং এই আত্মহত্যাকারীদের ৮৭৯ জনই নারী। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় এই হার ৭০ শতাংশ বেশি।
বিজ্ঞাপন
এর আগে ২০০৮ সালে ব্যাংক ব্যবস্থার সংকট এবং ১৯৯০ সালে শেয়ার বাজারে ধস নামার পর আত্মহত্যা বেড়ে গিয়েছিল জাপানে। তবে সে সময় আত্মহত্যাকারী অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবয়সী পুরুষ।
কিন্তু করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর দেশটির নারীরা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু কী কারণে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছেন নারীরা— এ প্রশ্নের জবাবে জাপানের মনোচিকিৎসক জুন তেশিবানা বিবিসিকে বলেন, মানসিক অবসাদ বা বিষাদগ্রস্ততা, যৌন নিগ্রহ, লকডাউনের কারণে চাকরিচ্যুতি ও হতাশা জাপানের নারীদের আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অবসাদ বা বিষাদগ্রস্ত নারীদের মানসিক সহায়তা দিতে কাজ করা ‘বন্ধন’ নামে একটি প্রকল্পের পরিচালক ৪১ বছর বয়স্ক তেশিবানা বলেন, ‘জাপানে যখন কোনো নারী সত্যিকার অর্থেই কোনো বিপদ বা যন্ত্রণার মধ্যে থাকেন তখন কী করবেন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বই অনেক সময় আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয় তাদের।’
বিবিসিকে তেশিবানা জানান, করোনা লকডাউন শুরুর পর থেকে জাপানের পারিবারিক যৌন ও মানসিক নির্যাতন মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ক একটি কেসস্টাডি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি একজন তরুণীকে আমরা মানসিক সহায়তা দিচ্ছি। সে ছোটবেলা থেকেই তার বাবার হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে আসছিল এবং সাম্প্রতিক করোনা লকডাউনের কারণে মাত্রাতিরিক্তভাবে এটি বেড়ে গিয়েছিল।’
তিনি বলেন, প্রথম যখন ওই তরুণীর সঙ্গে তার কথা হয় তখন সে বারবার ঘুরে ফিরে বলছিল তিনটি কথা, ‘আমি মরতে চাই’, ‘আমার যাওয়ার কোনও যায়গা নেই’ এবং ‘আমি হারিয়ে যেতে চাই, কারণ আমি খুব একা’।
মহামারির কারণে সৃষ্ট বেকারত্বও জাপানের নারীদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন দেশটির আত্মহত্যা ও মানসিক রোগ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মিশিকো উয়েদা।
বিবিসিকে তিনি জানান, জাপানের কর্মজীবী নারীদের বড় অংশই খাদ্য প্রস্তুত শিল্প, পর্যটন ও খুচরা দোকানদারি ব্যবসায় নিয়োজিত। করোনা মহামারির কারণে এই খাতগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মিশিকো উয়েদা বলেন, ‘জাপানে এমন বহু নারী রয়েছেন, যারা একা থাকেন এবং নিজেদের ও পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য ছোটোখাটো কাজই যাদের একমাত্র জীবিকা। মহামারির করণে তাদের জীবিকার সংস্থান ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
‘তবে এটা আমি স্বীকার করবো, আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে দেশজুড়ে আত্মহত্যার এমন উচ্চহার দেখতে হবে তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি আমি।’
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। কয়েক দশক ধরে তা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সেগুলোর ইতিবাচক ফলাফলও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক মহামারি দেশটিতে আত্মহত্যার যে চিত্র তুলে ধরেছে তাতে বিগত সব হিসেবে ওলট-পালট হয়ে গেছে।
সূত্র: বিবিসি
এসএমডব্লিউ