সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ দোকানপাট

সময় সন্ধ্যা সাতটা। রেস্টুরেন্ট ফাঁকা, ক্যাসিনো বন্ধ, রাস্তায় হাতেগোনা কয়েকজন হেঁটে যাচ্ছেন। এ যেন এক অচেনা শহর কাঠমান্ডুর থামেল। কাঠমান্ডু ও পুরো নেপাল সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়লেও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকত পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা থামেল। ইউরোপিয়ান, আমেরিকান, আফ্রিকান পর্যটকদের পদচারণায় সবসময় মুখরিত থাকত বাণিজ্যিক শহরটি। কিন্তু করোনার থাবায় সেই থামেল এখন কাঠমান্ডুর অন্য দশটা শহরের মতোই।

থামেল এলাকায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে হোটেল ব্যবসা করছেন প্রদীপ। পাঁচতলা হোটেলে রয়েছে ৪৬টি কক্ষ। এই ৪৬টি কক্ষের মধ্যে মাত্র ৮টি কক্ষে এখন কাস্টমার রয়েছে। করোনার প্রভাব সম্পর্কে এই হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ‘নেপাল পর্যটন নির্ভর দেশ। করোনার কারণে পর্যটকরা এখন কম আসছেন। লকডাউনে হোটেল ব্যবসা ছয় মাস বন্ধ ছিল। রীতিমতো এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন এখানকার হোটেল ব্যবসায়ীরা'।

তিনি বলেন, ‘করোনার এ সময়ে সরকারের কাছ থেকে আমাদের তেমন কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। আয় নেই বললেই চলে, কিন্তু খরচ প্রায় আগের মতোই। বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প কয়েকজন স্টাফ নিয়ে হোটেল খুললেও পর্যটক নেই।’

হোটেল ব্যবসায়ীদের চেয়েও করুণ পরিণতি দেখা গেলো মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়কারীদের। মুদ্রা ব্যবসায়ী দিপেশ থিমালসিনা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে লোকজন আসা যাওয়া করছেন। এতে অনেকেই দু’একদিনের জন্য হোটেলে থাকছেন। কিন্তু বিদেশি পর্যটক আসা যাওয়া না হলে তো ডলার, রুপির লেনদেন হয় না। তাই আমাদের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে'।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ এভারেস্ট দেখতে ও আরোহণ করতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক নেপাল ভ্রমণ করেন। এভারেস্ট ছাড়াও নেপালজুড়ে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। রয়েছে ধর্মীয় স্থাপনা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুরনো মন্দির ছাড়াও গৌতম বুদ্ধের বেশ কয়েকটি নিদর্শন রয়েছে নেপালে। ফলে প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সব দিক বিবেচনা করেই সারা বছরজুড়ে পর্যটকদের ভিড় থাকে নেপালে। 

রেস্টুরেন্ট বন্ধ, ফিরে যাচ্ছেন কাস্টমার

নেপালে ইংরেজি জানা অনেক তরুণ শিক্ষার্থী ও সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীরা পর্যটকদের গাইড হয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। করোনায় সেই পথটাও বন্ধ হয়েছে তাদের। ২৪ বছর বয়সী রাজু বিকাশ গাইডদের অবস্থা ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘আমাদের আয়ের পুরো উৎসটাই নির্ভর করে পর্যটকদের ওপর। পর্যকটরা না আসায় আমাদের আয়ও বন্ধ ছিল। এখন কিছু পর্যটক এলেও করোনার কারণে তারা সেভাবে ঘোরাঘুরি করেন না। কারণ সবার নেগেটিভ সনদ নিয়ে দেশে ফেরার একটা তাড়া থাকে’। 

কাঠমান্ডুজুড়ে মোটরসাইকেলের আধিক্য দেখা যায়। সাশ্রয়ী হওয়ায় নেপালিদের মতো পর্যটকরাও এখানে এসে মোটরসাইকেল চালান। পর্যটকদের বিষয়টি মাথায় রেখেই ২০২০ সালের শুরুর দিকে মোটরসাইকেল শো রুম দিয়েছেন ব্যবসায়ী সঞ্জীব শিল্পাকার। করোনায় তার এই ব্যবসা অনেকটা স্থবির। তিনি বলেন, ‘চীনারা ব্যবসা ও ঘুরতে উভয় কাজে আসতেন নেপালে। করোনার কারণে নেপাল-চীন বর্ডার সবার আগে বন্ধ হয়। ফলে পর্যটন ও ব্যবসা উভয় খাতে নেপাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি।’ 

২০১৫ সালে নেপালে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে প্রায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ভেঙে যায়। মারা যান প্রায় দেড় হাজার মানুষ। ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে নেপাল সরকার পর্যটনকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিল। ‘ভিজিট নেপাল ২০২০’ স্লোগান তৈরি করে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ভূমিকম্পের চার বছর পর ২০১৯ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিক খ্যাত এসএ গেমস আয়োজন করে পর্যটন বিশ্বে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছিল হিমালয় অধ্যুষিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি। 

২০২০ সালে নেপাল সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০ লাখ পর্যটক আনা। পর্যটক আকর্ষণে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আধুনিকায়নসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে নেপাল সরকার মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু করোনা ‘ভিজিট নেপাল ২০২০’ সফল হতে দেয়নি। আগামী দিনে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন দেখার অপেক্ষা।

এজেড/জেডএস