নারীরা কাঁদছেন। কান্নার পাশাপাশি দেখাচ্ছেন ক্রোধ। তরুণরা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে ছুঁড়ে স্লোগান দিচ্ছেন। মাস্ক পরা লোকজন শূন্যে গুলি ছুঁড়ছেন। এমন দৃশ্য দেখা গেছে শোকে বিপর্যস্ত আল-আমারি ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে; যেখানে ইসরায়েলি গুপ্তহত্যা বাহিনীর হাতে নিহত আহমেদ ফাহাদ (২৪) নামে এক তরুণের জানাজার আয়োজন করা হয়েছিল।

ফাহাদের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, ইসরায়েলি আন্ডারকভার অ্যাজেন্টরা গত মঙ্গলবার প্রথমে আহমেদ ফাহাদকে গ্রেফতার করে। পরে একই দিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে একেবারে কাছে থেকে পেছনে বেশ কয়েকবার গুলি চালানো হয়। রামাল্লাহর পার্শ্ববর্তী আম আল-শায়ারেত এলাকার রাস্তায় রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে ছিল ফাহাদের।

ছেলের ছবি আঁকড়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন ফাহাদের মা। সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় এই মা তার কান্না থামাতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে গুলি করা হয়েছে। সে আমার ভালোবাসার সন্তান; যার অনেক বন্ধু ছিল। সে সবসময় হাসিমুখে থাকতো।’ 

এল বিরেহ পৌরসভার কর্মী ফাহাদের আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুহাম্মদ আল-আওদা বলেন, রামাল্লাহ হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতে— একেবারে কাছ থেকে ফাহাদকে কয়েকবার গুলি করা হয়।

তিনি বলেন, চিকিৎসকরা বলেছেন— ফাহাদের শরীরের পেছনে যে কয়েকটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছে; তার মধ্যে একটিতে প্রায় আড়াই সেন্টিমিটার গর্ত পাওয়া গেছে। সেই বুলেটটি পেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাত সেন্টিমিটার গর্ত হয়েছিল— এতে প্রমাণিত হয় যে, তাকে খুব কাছে থেকে গুলি করা হয়েছে। 

ফিলিস্তিনি মেডিক্যাল কর্মীরা বলেছেন, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাজা গুলি ব্যবহার করেছে; যা ‘বাটারফ্লাই বুলেট’ নামে পরিচিত। আঘাত হানার পর এই বুলেট বিস্ফোরিত হয়। শরীরের টিস্যু, ধমনী এবং হারে অভ্যন্তরীণ এবং বৃহৎ জখম তৈরি করে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই মুখপাত্র বলেন, তার নিজের পায়েও বেশ কয়েক রাউন্ড বুলেটের জখম রয়েছে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরবর্তীতে ফোন করে ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তার পরিবারের সদস্যদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ফাহাদের পারিবারিক বন্ধু সাবরিন আবু লিবদেহ। টেলিফোনে শিন বেটের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, তরুণ ফাহাদকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল না ইসরায়েলি অ্যাজেন্টদের। তার ভাই এবং চাচার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠায় এটি ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।

ভাইয়ের মৃত্যু শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে ফাহাদের বোন রোসিয়ানের। তিনি বলেন, ‘এখন তাদের ক্ষমা চেয়ে কী হবে? এতে কি তাকে ফেরত পাওয়া যাবে?’

ফিলিস্তিনিদের গুপ্তহত্যা

বিশেষ এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ইসরায়েলিরা যখন নিজেদের ভুলের কথা স্বীকার করছে, তখন রামাল্লাহর স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আল-হকের শাওন জাবারিন বলেন, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান হত্যাকাণ্ড— বিশেষ করে আন্ডারকভার অ্যাজেন্টদের হাতে হত্যা কোনও দুর্ঘটনা নয়।

তিনি বলেন, আমরা ফাহাদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করছি। মুসতা’রিবিন নামের ইসরায়েলি আন্ডারকভার অ্যাজেন্টের কাছ থেকে ফিলিস্তিনিদের হত্যায় ইসরায়েলি বেপরোয়া নীতির অংশ ছিল ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। ইসরায়েলি সৈন্যরাও প্রতিনিয়ত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে।  

শাওন জাবারিন আলজাজিরাকে বলেন, সৈন্যরা প্রায় প্রত্যেক রাতে ২টার পর রামাল্লাহ এসে গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করেন। কাছে থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা অথবা জখমের পর শিন বেটের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করেন। এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা আছে। এমনকি আহত তরুণদের উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্সও ঢুকতে দেয় না আন্ডারকভার অ্যাজেন্টরা। তবে এই তরুণদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার অভিযোগ আছে।

তিনি বলেন, ‌‘সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, এসব প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড।’

মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রে স্পিডিং বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এবং সীমান্ত পুলিশকে সহায়তা করে আন্ডারকভার অ্যাজেন্ট মুসতা’রিবিন। ইসরায়েলবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি শালহাত বলেন, মুসতা’রিবিনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা।

প্রতিনিয়ত মানবাধিকারের লঙ্ঘন

এখনও প্রায় প্রত্যেকদিন ফিলিস্তিনি হত্যাকাণ্ড ঘটছে। চলতি মাসেই শুধুমাত্র পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অথবা বিক্ষোভের সময় কমপক্ষে ২৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বি’টিসেলেম এক প্রতিবেদনে বলেছে, ফিলিস্তিনিদের ক্ষয়ক্ষতি করেছেন এমন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীকে কোনও ধরনের অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয় না।

২০০০ সালের শেষের দিকে শুরু হয়ে ২০১৫ সালে শেষ হওয়া ফিলিস্তিনি দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের সময়ের কিছু ঘটনার বরাত দিয়ে বি’টিসেলেম ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতে ফিলিস্তিনি হত্যা, আহত এবং মারধরের অন্তত ৭৩৯টি ঘটনা তদন্তের দাবি তুলেছিল। ২০১৬ সালের মাঝের দিকে এসেও এসব ঘটনার এক চতুর্থাংশেরও তদন্ত করা হয়নি। এমনকি বিচারের মুখোমুখিও হতে হয়নি ইরসায়েলি সৈন্যদের।

এসএস