সু চি: গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক থেকে অতীত বিসর্জন দেওয়া এক নাম
মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান নেতা অং সান সু চিকে আটক করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। একইসঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকেও আটক করা হয়েছে। সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন নিয়ে সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান টানাপোড়েনের মধ্যেই সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল।
দীর্ঘ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার কারণে অং সান সু চিকে বলা হতো ‘মানবাধিকারের বাতিঘর’। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে প্রায় ১৫ বছর বন্দী জীবন কাটিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুই বছর পর এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
বিজ্ঞাপন
সু চিকে একসময় মানবাধিকারের বাতিঘর বলা হতো। একজন নীতিবান অধিকারকর্মী হিসেবে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় থাকা সামরিক জেনারেলদের চ্যালেঞ্জ করতে নিজের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৯১ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় এবং তাকে ‘ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার অনন্য উদাহরণ’ হিসেবে সম্বোধন করা হতো। তখনও তিনি গৃহবন্দীই ছিলেন। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অন্তত ১৫ বছর বন্দী জীবন কাটিয়েছেন সু চি।
২০০৮ সালে সেনাবাহিনী নতুন সংবিধান রচনা করার পর দেশটিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে। ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। তবে সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি সু চির দল।
এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতৃত্ব দেন সু চি। ওই নির্বাচনে বড় জয় পান তিনি। নির্বাচনে জিতলেও মিয়ানমারের সংবিধানে বিধিনিষেধ থাকায় তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কারণ সু চির সন্তানেরা বাইরের দেশের নাগরিক। তবে ৭৫ বছর বয়সী সু চি একজন ডি ফ্যাক্টো নেতা হিসেবেই সুপরিচিত।
তবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নেতৃত্বকে দেশটিতে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি হওয়া আচরণ দিয়েই বর্ণনা করা হয়। ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ স্টেশনে প্রাণঘাতী হামলার পর রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়।
অভিযোগ রয়েছে- রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ধর্ষণ, হত্যাসহ ব্যাপক গণহত্যা রুখতে কোনো পদক্ষেপ নেননি সেসময় স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অং সান সু চি। এমনকি জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও ব্যাপকভিত্তিক গণহত্যার অভিযোগ সত্বেও দেশটির ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর নিন্দা কিংবা তাদের নৃশংসতার মাত্রাও স্বীকার করেননি তিনি।
প্রাথমিকভাবে অনেকেই সু চির পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে বলেছেন, তিনি একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। কারণ বহু-জাতি বিশ্বাসের সম্প্রদায়ভুক্ত এমন একটি দেশ শাসন করছেন সু চি, যার জটিল ইতিহাস রয়েছে।
তবে ২০১৯ সালে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানিতে সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপের বিষয়ে তার নিজের পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর তার আন্তর্জাতিক সুনাম বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। মূলত তিনি তার গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই হারিয়েছেন।
দেশের ভেতরে ‘দ্য লেডি’ নামে পরিচিত সু চি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম