• স্বৈরশাসনের পাঁচ দশক পর ২০১১ সালে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন
• ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিকভাবে ১ম জাতীয় নির্বাচনে জয় পায় সু চির দল এনএলডি
• চার বছর পর গত বছরের নভেম্বরেও জয় পায় এনএলডি
• নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ করে সেনাবাহিনী
• সোমবার দেশটিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী

এক দশক আগে আশায় বুক বেধেছিল মিয়ানমার। যে আশার অবসান ঘটল দশ বছর পর। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক অং সান সু চি দেশটির গণতান্ত্রিক যাত্রায় ফিরতে দেখলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এক কলঙ্কের আঘাত।

২০১০ সালের শান্ত নভেম্বরের এক সন্ধ্যায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ইউনিভার্সিটি এভিনিউয়ের সামনে ব্যারিকেড দিয়েছিল; যা দেশটির নেত্রী অং সান সু চিকে তার জনগণের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। লুঙ্গি এবং জুতাে পরিহিত সমর্থকরা তার বাড়ির বাইরের ৪০০ গজ দূরের ফটকে জমায়েত হন। ‌‘দ্য লেডি’ খ্যাত টি-শার্ট পরিহিত অং সান সু চি বাড়ির বাইরে শত শত সমর্থককে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। এ সময় সমর্থকরা ‘সু চি দীর্ঘজীবী হোন’ স্লোগানে তার বাড়ির চত্বর মুখরিত করে তোলেন।

সু চি গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্তি পাওয়ায় মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীদের মতো বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে আনন্দে ভাসতে দেখা যায়। কয়েক দশকের সামরিক জান্তা শাসনে পিষ্ট গণতান্ত্রিক যাত্রার লড়াইয়ের সেই সন্ধ্যায় সু চির এই মুক্তি মিয়ানমারকে নতুন দিশা দেবে বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট আশাপ্রকাশ করেন।

মিয়ানমারের জাতির জনক জেনারেল অং সান; যিনি দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং দেশের স্বাধীনতার নায়ক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তার কন্যা অং সান সু চি ১৫ বছরের গৃহবন্দি জীবন কাটান; দেশটিতে হয়ে ওঠেন গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতীক।

গৃহবন্দি থাকাকালীন দেশটির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন অং সান সু চি। সামরিক জান্তা শাসনের অবসানে দীর্ঘ লড়াইয়ের স্বীকৃতিতে সু চি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এবং মুক্তচিন্তার বিকাশে অবদান রাখায় শাখারভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদক পান তিনি।

মুক্তি পাওয়ার দশকে দেশে ফিরিয়ে আনেন গণতন্ত্র। দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনলেও অতিমাত্রায় রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর রোষাণলেও পড়েন তিনি। সাধারণ জনগণের মাঝেও তাকে নিয়ে বিরুপ ভাবনা শুরু হয়।

মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক অং সানের মেয়ে অং সান সু চি

২০১৫ সালে দেশটির নির্বাচনে সু চি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি ভূমিধস জয় লাভ করে। স্বামী মাইকেল অ্যারিস এবং সন্তানরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্টের আসনে বসতে পারেননি তিনি। এর পরিবর্তে স্টেট কাউন্সিলর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দেশটির ডি-ফ্যাক্টো নেত্রীর পদে বসেন তিনি।

পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে তার এই পতন অত্যন্ত দ্রুতই ঘটেছে।

ক্ষমতায় আসার পর দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করা দরকার হলেও সেটি করতে পারেননি সু চি। সেনারচিত মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সংসদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মোট আসনের ২৫ শতাংশ সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। যে কারণে তিনি সেনাবাহিনীর কাছে মৌলিকভাবেই দুর্বল ছিলেন।

ক্ষমতায় এলেও সেনাবাহিনীর এমন আঁকড়ে থাকা সংসদের যাত্রায় স্বাধীনভাবে কতদিন কাজ করতে পারবেন তা নিয়ে ছিল প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত ইউনিফর্ম পরিহিতদের কাছে পরাজয় বরণ করলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লড়াকু ‌‘দ্য লেডি’।

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার নিন্দা এবং এর লাগাম টানার কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি অং সান সু চি। নিজের বাবার প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীর এমন অপরাধে নীরব থাকায় পশ্চিমা বিশ্বের কাছে সু চির গণতান্ত্রিক লড়াই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যরা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি, নারীদের ধর্ষণ, হত্যার মতো নৃশংস অপরাধ সংঘটিত করে।

রোহিঙ্গাদের সারিবদ্ধ করে গুলি চালিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে

২০১৭ সালের আগস্টে দেশটির সেনাবাহিনীর এই নৃশংস অপরাধকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশি বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। 

বিশ্বের সবচেয়ে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সুরক্ষায় সু চিকে বিশ্ব নেতারা ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করেননি তিনি। এর পরিবর্তে তিনি রাখাইনের হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

অং সান সু চি বার্মা জাতীয়তাবাদী, তার চিন্তা-ভাবনার গভীরে জাতিগত সত্ত্বার ধারণা রয়েছে। কিন্তু তারপরও দেশটির সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি তিনি বরাবরই দৃষ্টি দেননি। দেশের মহান জাতীয়তাবাদী নায়কের কন্যা চিন্তা-ভাবনাই ছিল সু চির রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত দর্শনের মূল ভিত্তি।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, বাইরের দুনিয়ায় সু চিকে এখন ভিলেন হিসেবে দেখা হলেও দেশটিতে এখনও তার তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। তার প্রতি মিয়ানমারের নাগরিকদের অন্ধ ভালোবাসা রয়েছে। অভ্যুত্থানে অং সান সু চির আটক হওয়ায় দেশটিতে অত্যাচারী সামরিক শাসনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন ফিরছে।

আগামী এক বছরের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে দেশটির প্রতাপশালী এই বাহিনী। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত বছরের নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে অং সান সু চি এবং তার রাজনৈতিক দলের নেতাদের আটক করা হয়েছে। এখন তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হবে। আটক হওয়ার পর সু চি এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান না মেনে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। 

বার্মিজ সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল সহজেই হিতে বিপরীত হতে পারে।

মিয়ানমারবিষয়ক বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথিয়েসন

তিনি বলেন, আমি মনে করি না, দেশটির সামরিক বাহিনী সারাদেশের মানুষকে নীরব রাখতে পারবে। মিয়ানমারে এমন একটি প্রজন্ম রয়েছে যারা সু চির গৃহবন্দি দশায় বেড়ে উঠেছেন, আরেকটি প্রজন্ম রয়েছে যারা সু চির মুক্তির সময় বেড়ে উঠেছেন এবং তারা আসলেই তাকে সমর্থন করেন। জাতিগত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে প্রচুর মানুষ রয়েছে যারা তার পাশে, তার দলের পাশে না দাঁড়ালেও সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করেন।

নিজের সুনামের অপূরণীয় ক্ষতি করলেও অং সান সু চি আটক হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নিন্দা শুরু হয়েছে। দেশটিতে বর্তমানে গভীর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

মিয়ানমারের শিক্ষাবিদ থ্যান্ট মিয়ন্ট-ইউ বলেছেন, ভিন্ন এক ভবিষ্যতের দরজা সবেমাত্র খুলে গেছে। আমি এমন ভাবনায় ডুবে যাচ্ছি যে, আমার মনে হচ্ছে পরবর্তীতে যা ঘটতে যাচ্ছে তা কেউই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। এখানে মনে রাখা দরকার সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠী সদস্যদের সহিংসতা, ধর্মীয় এবং জাতিগত বিভাজনের চারণভূমি মিয়ানমারে আবারও নজিরবিহীন অস্থিরতা শুরু হতে পারে।

এসএ