শূন্য হাতে ফিরে চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি লাখ লাখ প্রবাসী
করোনা মহামারিতে দেশে ফিরে আটকে পড়া প্রবাসীরা কর্মক্ষেত্রে ফেরার জন্য টিকিট নিশ্চিত করতে ঢাকায় সৌদি বিমান সংস্থার অফিসের সামনে, অক্টোবর ২০২০/ ছবি: এসআইপিএ ইউএসএ/পিএ
• করোনা মহামারিতে কর্ম হারিয়ে দেশে ফিরেছেন ৪ লাখের বেশি প্রবাসী
• দেশে ফিরে চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা
• জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা
• প্রবাসফেরত অধিকাংশই বেকার হয়ে পড়েছেন; যাদের অর্ধেকের উপার্জন নেই
ফিরোজা বেগম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছিলেন। করোনাভাইরাস মহামারিতে জীবনের কঠিন এক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সৌদিতে তার নিয়োগকর্তা ছয় মাস ধরে কোনও বেতন না দেওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটানোর পর সঞ্চয়ের সবটুকু খরচ করে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফিরে পরিবারের সদস্যদের আরেক নির্মম চেহারা দেখেন তিনি। সঞ্চয় কিংবা হাতে অর্থ না থাকায় স্বামী তাকে বাড়িতে জায়গা দেননি। ফিরোজা ঠাঁই পেয়েছেন অসুস্থ মায়ের বাড়িতে।
বিজ্ঞাপন
করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী কর্ম হারিয়ে এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। এক সময় আর্থিক স্বচ্ছলতায় দিন কাটলেও চরম দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হচ্ছেন এমন লাখো প্রবাসী। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বাংলাদেশি প্রবাসীদের কর্মহীন হয়ে চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
করোনাভাইরাস মহামারিতে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বেতন ছাড়া নিয়োগকর্তার বাড়িতে ছয় মাস আটকে থাকার পর বাংলাদেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ফিরেজা বেগম। শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসায় তার স্বামী প্রচণ্ড রেগে যান। স্ত্রীকে বাড়িতে জায়গা দেননি তিনি।
বিজ্ঞাপন
মধ্যপ্রাচ্যে ১৪ বছরের কাজের সবটুকু সঞ্চয় খরচ করে নিপীড়ক নিয়োগকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি। ফিরোজা বেগমের বয়স ৪০ বছর। স্বামী জায়গা না দেওয়ায় বাবা-মায়ের কাছে চলে যান তিনি। সেখানে বৃদ্ধ মা ও প্রতিবন্ধী দুই বোনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের পরিবারে অর্থ পাঠিয়ে দেন। এই প্রবাসীদের পরিবার-স্বজনদের চরম দারিদ্র্য থেকে দূরে রাখতে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকায় আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের চেষ্টা করছে সরকার।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির অর্থনৈতিক প্রভাবে লাখ লাখ প্রবাসী কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। সরকারের গবেষণা বলছে, কর্মহীন এসব প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা যে দারিদ্র্য থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন; এখন আবার সেখানেই ফিরছেন। এক বছর আগেও ফিরোজা বেগমের মাসিক আয় ছিল ২২ হাজার টাকা। সৌদি আরবে এক চিকিৎসকের পরিবারে গৃহকর্মী ছিলেন তিনি। তার উপার্জনের প্রায় সবটুকুই ঘর মেরামত, জমি কিনতে এবং চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য স্বামী অথবা বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
এখন আমার কোনও উপার্জন নেই। আমার পরিবারের মাসিক খরচ মেটাতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
সৌদি ফেরত ফিরোজা বেগম
আমরা এখন বেঁচে আছি আত্মীয়-স্বজনদের কাছে থেকে অর্থ ধার নিয়ে। তাদের কাছে আমার প্রায় দেড় লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে। আমি জানি না, তাদের এই ঋণ কীভাবে পরিশোধ করবো।’
বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিয়ত বিদেশে কাজের ক্ষেত্রে নাগরিকদের উৎসাহ দেয়। বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে; যা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবারের সদস্যদের স্বচ্ছলতা ও ছোট ছোট ব্যবসা পরিচালনা এবং দারিদ্র্য কমাতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের এপ্রিলে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা দরিদ্রতা হ্রাসে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে আবারও দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলছে, অভিবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্সে পতনের কারণে বিশ্বজুড়ে অতিরিক্ত আরও ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
বাংলাদেশি গবেষণা সংস্থা ইনোভিশনের এক জরিপ বলছে, নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলোতে অতিরিক্ত উপার্জন ছাড়াই গড়ে আট দিন চলার মতো সামর্থ্য আছে। এছাড়া অধিকাংশ পরিবারে খাদ্য-শস্যের এমন মজুদ রয়েছে, যা দিয়ে ১১ দিন পর্যন্ত চলতে পারবেন তারা।
গত জুনে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘকে দেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যাপারে হালনাগাদ তথ্য জানিয়ে দেয়। এতে বলা হয়, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যতার হার ৪০ শতাংশ থাকলেও ২০১৯ সালে তা অর্ধেক কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিদেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাজ হারানো এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এসডিজি অর্জনে সরকারের নীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। গত বছরের জুনে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাক প্রবাস ফেরত ৩৫ হাজার কর্মীর ডেটাবেইজ তৈরি করেছে। দেশে ফিরে আসার পর ব্র্যাক এই প্রবাসীদের নগদ অর্থ সহায়তা এবং পরামর্শ দিয়েছে। ব্রাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, গত বছরের শুরু থেকে ৪ লাখের বেশি অভিবাসী শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন; যাদের বেশিরভাগই কোনও সহায়তা পাননি। তিনি বলেন, ‘কর্ম হারিয়ে লোকজন একেবারে শূন্যহাতে দেশে ফিরে আসছেন। তারা জানেন না, ভবিষ্যতে কী ঘটবে।’
একজন অভিবাসী দেশে গড়ে কতজন মানুষকে সহায়তা করতেন তার একটি ধারণা দিয়েছেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, প্রবাসীদের এই কর্মহীন হয়ে পড়া দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে। এখনও বিদেশে অনেক বেকার প্রবাসী আটকা রয়েছেন।
গত জুনে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএমের এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের অধিকাংশই বেকার হয়ে পড়েছেন; যাদের অর্ধেকের কোনও উপার্জন নেই।
গত এক দশকে উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীর পশ্চিম চরবাটা গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তাদের বেশিরভাগই গ্রামে ফিরে এসেছেন। তারা বাড়িতে বসে কাজের জন্য দুশ্চিন্তা করছেন, বাড়ছে ঋণের বোঝা।
এই গ্রামের বাসিন্দা ৩৯ বছর বয়সী রিয়াজ মাহমুদ বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি আমার জীবন থামিয়ে দিয়েছে। আমার জীবনের গতি একেবারে শীর্ষে পৌঁছেছিল। কিন্তু বর্তমানে তা মাটিতে নেমে এসেছে। পরিবারও অনেক ভালো ছিল। আমার পরিবারের জন্য ইচ্ছে মতো অর্থ ব্যয় করতে পারতাম। কিন্তু এখন তাদের দৈনিক ব্যয় মেটানোই অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশ ছেড়ে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী হিসেবে কাতারে যাওয়ার জন্য তিনি প্রায় ৩ লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন। দেশে ফিরে আসার পর এখন তার এই ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ টাকায়। কাতার থেকে দেশে ফিরে ওমানে গিয়ে ব্যক্তিগত চালকের কাজ নিয়েছিলেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারিতে ভ্রমণ বিধি-নিষেধের কারণে দেশে আটকা পড়েন তিনি। গত দুই বছরের মধ্যে এটাই ছিল তার প্রথম ছুটি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।
এসএস