দীপনকে যে বছর হত্যা করা হয় সেই ২০১৫ সালে একই ধরনের আরও কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে

প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় কী বিচার পাবে তার পরিবার, তা জানা যাবে বুধবারই। হত্যাকাণ্ডের ৫ বছরেরও বেশি সময় পার হওয়ার পর এ রায় আসতে যাচ্ছে। বই প্রকাশের জন্য প্রকাশককে হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম ছিল বাংলাদেশে, ফলে এ রায়ের গুরুত্বে রয়েছে ভিন্ন মাত্রা। 

বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলায় সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীর আশা খালাস পাবেন সব আসামি। রায়ের একদিন আগে এসে এ নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলতে চাচ্ছেন না দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বলছেন, রায় আসুক, তারপর যা বলার বলবো। 

দীপন ছিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশনীর কার্যালয়ে খুন হন তিনি। একই বছর ফেব্রুয়ারিতে একই ধরনের আরেকটি হামলায় নিহত লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের কয়েকটি বইয়ের প্রকাশক ছিলেন তিনি। দীপন হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদে সরব হয়েছিল বাংলাদেশ। জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে হরতালও ডেকেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। 

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর জাগৃতি প্রকাশনীর লালমাটিয়া কার্যালয়েও হামলা চালানো হয়  

দীপনকে যেদিন খুন করা হয় সেই একই দিনে আরেক হামলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনের স্বত্তাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল, লেখক তারেক রহিম এবং কবি ও ব্লগার রণদীপম বসুকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। জাগৃতির লালমাটিয়ার কার্যালয়ে ওই হামলার ঘটনা ঘটে।

এ দুই হামলার ঘটনা ছাড়াও ২০১৫ সালে আরও বেশ কিছু হামলার ঘটনা ঘটে। ওই বছর একুশে বইমেলা চলার সময় টিএসসিতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়কে। এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়সহ কয়েকজন ব্লগার-লেখককে হত্যা করা হয়।

দীপন হত্যা মামলার রায়ের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর গোলাম সারোয়ার খান জাকির ঢাকা পোস্টকে বলেন,‘এ মামলায় মোট আসামি ৮ জন। এর মধ্যে দুজন পলাতক রয়েছেন। আর বাকি ছয়জন কারাগারে। আমরা এ মামলায় আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, সাক্ষী ও আইনের ব্যাখ্যা আদালতে উপস্থাপন করেছি। আমরা আশা করি সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে।’ 

আদালত রায় ঘোষণা করুক। তারপরে যা বলার বলবো। এখন রায় বা মামলার বিষয়ে কোনো কিছুই মন্তব্য করবো না।

দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

আসামিদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কিভাবে যোগসাজশ রয়েছে আদালতে সেটিও দেখিয়ে দিয়েছি বলেও দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীর দাবি, তিনিও দেখিয়ে দিয়েছেন যে এ মামলার সাথে তার মক্কেলরা জড়িত নন। 

রায়ে কী প্রত্যশা করেন এমন প্রশ্নের জবাবে দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদালত আগামীকাল (১০ ফেব্রুয়ারি) রায় ঘোষণা করুক। তারপরে যা বলার বলবো। এখন রায় বা মামলার বিষয়ে কোনো কিছুই মন্তব্য করবো না।

এদিকে এ মামলার সব আসামিই খালাস পাবেন বলে আশা করছেন আসামিদের আইনজীবী নজরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন,‘আসামিরা এই মামলা থেকে খালাস পাবেন বলে  আমরা আশা করি। আমরা মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় আদালতে দেখিয়ে দিয়েছি আসামিরা এই ঘটনার সাথে জড়িত নয়। এই ঘটনার সাথে আসামিদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মামলাটিতে ২৩ জন সাক্ষী আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করেছেন। তাদের মধ্যে একজন সাক্ষীও সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বলতে পারেনি। শুধুমাত্র এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আসামিদের নাম বলেছেন, তাছাড়া মামলার অভিযোগপত্রে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। সুতরাং আমরা আশা করি এ মামলায় সব আসামি খালাস পাবেন।’

গত ২৪ জানুয়ারি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুনানি শেষে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রায় ঘোষণার জন্য ১০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। মামলায় মোট ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

হত্যাকাণ্ড থেকে রায়ের তারিখ ঘোষণা 
• ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর খুন হন দীপন 
• ওই দিনই মামলা করেন দীপনের স্ত্রী 
• ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর  অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় 
• ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করা হয় 
• রায় ঘোষণার জন্য ১০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয় ২৪ জানুয়ারি

ছেলেকে হারানোর পর বাবা আবুল কাশেম 

মামলার আসামিরা হলেন- মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুর সবুর সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাধ, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার এবং শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের। মামলায় প্রথম দু’জন পলাতক রয়েছেন।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সেদিন বিকেলে তার স্ত্রী শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি দক্ষিণের সহকারী পুলিশ কমিশনার ফজলুর রহমান। চার্জশিটে ৮ জনকে অভিযুক্ত ও ১১ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।

২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবুর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

টিএইচ/এনএফ