তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পৃথক সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্টের যত আলোচিত রায়
সদ্য বিদায় হতে যাওয়া ২০২৫ সাল ছিল সুপ্রিম কোর্ট তথা বিচার বিভাগের ইতিহাসে আলোচিত ও ঘটনাবহুল একটি বছর। এ বছরে অনেক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে বিচার বিভাগে। দীর্ঘ দুই যুগ অপেক্ষার পর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের যাত্রা শুরু করেছে। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে স্থান পাবে।
এ বছরেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপিত হয়েছে। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে অধস্তন আদালতের বিচারককের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে এসেছে। আপিল বিভাগের রায়ে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ও প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পেয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কয়েকটি ধারা বাতিল, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আসামিদের খালাস, মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে খালাস, আলোচিত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপসহ আসামিদের সাজা বহাল, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ আসামির সাজার বহালের রায়সহ বিদায়ী বছরের বহু আলোচিত ও যুগান্তকারী রায় ও আদেশ এসেছে উচ্চ আদালত থেকে।
বিজ্ঞাপন
এবছরই প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যাবেন বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এসব নানাবিধ কারণে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, সুপ্রিম কোর্ট থাকবে ২০২৫ সালের কথা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল : বিদায়ী বছরের ২০ নভেম্বর বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
বিজ্ঞাপন
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর ৬ বিচারপতি হলেন— বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রায় ঘোষণার সময় আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ ছিল।
এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারে অধীনে। চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৭ বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের বিদায় : আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোচিত প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন অক্সফোর্ড ডিগ্রিধারী বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। রাজপথে ছাত্র-জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগের ইতিহাসে তিনিই প্রথম হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তার দায়িত্বপালনকালীন সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠাসহ বিচার বিভাগ সংস্কারে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা ইতিহাসে অমলিন হয়ে থাকবে। ২০২৫ সাল তার বিদায়ের বছর হিসেবেও মনে রাখবে আইনাঙ্গনের মানুষেরা।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে আপিল বিভাগের রায় : বিদায়ী বছরের ১ জুন রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে জামায়াতের নিবন্ধনসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য ইসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আবেদনের শুনানি শেষে এ রায় দেন। এই রায়ের ফলে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ও প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পায়।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনী বাতিল : ২০২৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সম্বলিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করে এবং বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এই রায়ের ফলে অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ফিরে এসেছে।
বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাবনা অনুসারে তিন মাসের মধ্যে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি রায়ে বিচারকদের জন্য ২০১৭ সালে তৈরি করা শৃঙ্খলাবিধি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয়েছে। এ রায়ের ফলে এখন থেকে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টকে আর ধরণা দিতে হবে না।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ের ফলে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ফিরে এলো। এখন থেকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নামে বিচারকদের বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে আর কোনো নাটাই থাকলো না। নির্ভয়ে তারা রায় দিতে পারবেন। রায় দেওয়ার পর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে রাতের আধারে বিচারকদের বদলির আর কোনো ভয় থাকলো না। এ রায়টি একটি ঐতিহাসিক রায়।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের যাত্রা শুরু : উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে বিদায়ী বছরে বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে।
গত ১১ ডিসেম্বর বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়ের উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে ভবিষ্যৎ সরকারের সমর্থন লাগবে। শুধু তাই নয় স্বাধীন বিচার বিভাগের সফলতা ও ব্যর্থতা— দুটিই আমাদের মানতে হবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই পৃথক সচিবালয় করা সম্ভব হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, এখন থেকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে বিচার বিভাগ কাজ করতে পারবে, এ ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন।
এর আগে, গত ২০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।
বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রীকরণ নিশ্চিতকরণে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে গত বছরের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন-সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাবনা অনুসারে তিন মাসের মধ্যে মধ্যে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া খালাস : বিদায়ী বছরের ৪ নভেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজা থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে খালাস দিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়।
গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্ব সম্মতিক্রমে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছিলেন।
রায়ে আদালত বলেছেন, “এই (মামলার) আপিলসমূহের বিষয়বস্তু গঠনকারী কার্যধারাগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে গঠন করায় তা আইনের স্পষ্ট অপব্যবহার বলে প্রতীয়মান হয়েছে। যা দুরভিসন্ধিমূলক মামলার সমতুল্য।”
রায়ে আদালত আরও বলেছে, “এই রায় অন্যান্য দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, যারা এ মামলায় আপিল করেননি।”
গত ১৫ জানুয়ারি আপিল বিভাগের রায়ে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়। এ কারণে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্য আসামি আপিল না করেও সাজা থেকে খালাস পান।
মামলায় খালেদা জিয়াসহ তিনজনের করা আপিল মঞ্জুর করে গত ১৫ জানুয়ারি) এই রায় দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিতে এ রায় দেন।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমান খালাস : বিদায়ী বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামির খালাসের হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নতুন করে তদন্তে হাইকোর্ট যে পর্যবেক্ষণে দিয়েছিলেন তা বাদ দেন সর্বোচ্চ আদালত। আদালত বলেছেন, নতুন করে তদন্ত করবে কি না, সেটি সরকারের বিষয়।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা আপিল খারিজ করে আপিল বিভাগ এ রায় দেন। বেঞ্চের অন্য ৫ জন হলেন, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। আদালতে তারেক রহমান-বাবরের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারকে খালাস : বিদায়ী বছরের ২৭ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস দেন আপিল বিভাগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালত এ রায় দেন।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য ৬ হলেন, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো. আসাদুজ্জামান, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। বেঞ্চের ৭ বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় দিয়েছেন। রায়ে আপিল বিভাগ অবিলম্বে এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মুক্তির নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে ইতিহাসে এই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেলেন। এই রায়ের ফলে জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম কারামুক্তি পান।
আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল : বিদায়ী বছরের ১৬ মার্চ বহুল আলোচিত বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও ৫ আসামির যাবজ্জীবন বহাল রাখেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৫ জনের যাবজ্জীবনের আদেশও বহাল রাখা হয়।
বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং এসএম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি হলেন— বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।
বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন ডিজিটালাইজেশন করতে হাইকোর্টের রায় : বিদায়ী বছরের ১১ ডিসেম্বর ও তালাক নিবন্ধন ডিজিটালাইজেশন করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সব নাগরিক যেন এই ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আসিফ হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট তানজিলা রহমান।
২০২১ সালের ৪ মার্চ ভুক্তভোগী চারজনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান এ-সংক্রান্ত রিট দায়ের করেন। রিটে বলা হয়, প্রতারণা ঠেকানো ও পারিবারিক সম্মান রক্ষায় বিয়ে ও তালাকের নিবন্ধন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করা জরুরি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২২ মার্চ বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে বিয়ে ও তালাকের ঘটনা ডিজিটালভাবে নিবন্ধনের জন্য কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইট কেন তৈরি করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।এ রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা নিয়ে হাইকোর্টের দ্বিধা-বিভক্ত রায় : বিদায়ী বছরের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুলে দ্বিধা বিভক্ত রায় দেন হাইকোর্ট। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফাতেমা নজীব চুক্তি প্রক্রিয়া অবৈধ ঘোষণা করেন। বেঞ্চের জুনিয়র বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ার রিট খারিজ করে চুক্তি প্রক্রিয়া বৈধ ঘোষণা করেন। বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ারের হাইকোর্ট বেঞ্চ পৃথক পৃথকভাবে এ রায় ঘোষণা করেন। এখন নিয়মানুযায়ী প্রধান বিচারপতি বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন।
ইসির সিদ্ধান্ত অবৈধ, বাগেরহাটে চারটি আসন পুনর্বহাল : বিদায়ী বছরের ১০ ডিসেম্বর বাগেরহাটের চারটি আসন থেকে একটি কমিয়ে তিনটি আসন করে নির্বাচন কমিশনের গেজেট অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৫ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের লিভ টু আপিল খারিজ করে এ রায় দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী। ইসির পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কামাল হোসেন মিয়াজী। এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর বাগেরহাটের চারটি সংসদীয় আসন পুনর্বহাল করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট জারি করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়ে রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে ইসি।
এমএইচডি/এসএম