১৮১০ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যারিলবোনে প্রথম যে রেস্তোরাঁ তৈরি হয় তার নাম হিন্দুস্তানী কফি হাউস। যিনি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি একজন বাঙালি এবং তার নাম শেখ দীন মোহাম্মদ। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এক বছরের মধ্যে রেস্তোরাঁটি বিক্রি করে দেন তিনি। 

মেধাবী ও প্রতিভাবান উদ্যোক্তা ১৭৯৪ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। যুক্তরাজ্যে তার রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার পথ ধরে ভারতীয়দের অনেকেই এখন রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন। সেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ ভারতীয় রেস্তোরাঁ রয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগই পরিচালনা করছেন বাংলাদেশিরা।

টি-টুলিয়ার ব্যাপারে আমরা শুধু মানুষের চা খাওয়ার অভ্যাস তৈরির স্বপ্ন দেখিনি, আমরা যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরার চ্যালেঞ্জও নিতে চেয়েছি। ব্যবসা শুরুর সময়ে মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে তুলে না ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন যে বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব কম মানুষের ধারণা রয়েছে এবং বেশিরভাগই নেতিবাচক।

যুক্তরাজ্যে ভারতীয় পরিচয় দিলে সহজেই ব্যবসা করা যায়। এ কারণে আমরা ভারতের নামেই পরিচিত হয়েছি। এরপরেও ঔপনিবেশিক দেশ ব্রিটেনের শোষণমূলক মনোভাবের ব্যাপারে তেমন প্রশ্ন তুলিনি। নিজেদের স্বার্থেই এসব মেনে নিয়েছি। গত কয়েক বছরে বাজারে নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে শূন্যতা দেখা গেছে। ডিশুম, জিমখানা, তৃষ্ণা, দার্জিলিং এক্সপ্রেস এবং অন্যান্য অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সফলতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। যদিও ভারতীয়দের চেয়ে বাংলাদেশিরা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এগিয়ে রয়েছে, তারপরেও এখানে বাংলাদেশি সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। 

অনেকেই তর্ক করতে পারেন যে বাংলাদেশ রন্ধনশিল্পে স্বতন্ত্র অবস্থান রাখতে পারেনি। কিন্তু সেটি কখনোই সত্য নয়। লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে কিছু ব্যতিক্রমী রেস্তোরাঁ থাকতে পারে। হুইটচ্যাপেলের ব্রিকলেন ও কোলাপাতায় গ্রাম বাংলা ও আমার গাঁও রেস্তোরাঁকে বিজ্ঞাপনে বলতে শোনা যায় যে তারা বাংলাদেশি স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে। যুক্তরাজ্যের প্রায় সর্বত্রই ব্যবসা করছে তারা। খাবারের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের কালাভুনা ও মেজবানি গরুর মাংস, যশোরের চুইঝাল, সিলেটি ঐতিহ্যবাহী খাবার সাতকড়া কারি ও বিরিয়ানি এবং পুরোনো ঢাকার বাখরখানি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য ঐতিহ্যবাহী অবস্থান ধরে রেখেছে। 

যুক্তরাজ্যে ৮ হাজারের বেশি ভারতীয় রেস্তোরাঁ রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশিরা পরিচালনা করছেন এবং স্বতন্ত্র অবস্থান বলতে না পেরে তারা খুবই উদ্বিগ্ন। বাণিজ্যিকভাবে তারা সোহো এলাকায় হপার্স, কলাম্বিয়া বা প্যারাডাইসসহ অন্যান্য শ্রীলঙ্কার রেস্তোরাঁর লাভজনক অবস্থানে আসা দেখে উদ্দীপ্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশিরা যদি স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখতে চায়, তাহলে তাদের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। একসময়ে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া বাংলাদেশ এখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশকগুলো অতিক্রম করে চলেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ লিঙ্গসমতার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পক্ষান্তরে, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট আইন এবং কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মোদির ভারত প্রগতিশীল আদর্শ থেকে সরে এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে এসে বাংলাদেশ শিল্প, সঙ্গীত ও সাহিত্যে স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রেখেছে। 

এমন অবস্থায় রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব। গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ চ্যাম্পিয়ন নাদিয়া হুসেইন ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সে স্বকীয় অবস্থান দেখিয়েছেন। যেখানে নির্বাহী কমিটির প্রায় সবাই পুরুষ। স্বতন্ত্র পরিচয় না থাকায় বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু কিছু ব্যবসা চ্যালেঞ্জিং। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাং কারি। তারা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলে যে তারা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ থেকে তারা রেসিপি সংগ্রহ করে এবং বাংলাদেশের কারি ভারতীয় নামে চালিয়ে দেয়া হয়। আশা করি, বাংলাদেশিরা খুব দ্রুত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে।

দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত টি-টুলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক আহসান আকবরের লেখা অবলম্বনে এইচএকে/এইচএন/এএ