ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীজুড়ে এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে মানবজাতি এগোচ্ছে। যান্ত্রিকতা মানুষের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। মানুষের প্রতি মানুষের স্নেহ, সমবেদনা, ভালোবাসা যেন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বাসহীন এক সমাজে বাস করছি আমরা। এই প্রসঙ্গে কবি টি. এস. এলিয়ট বলেছিলেন, ‘বিশ্বাসহীনতা বিশ শতকের সবচেয়ে বড় সমস্যা।’

একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আমরা প্রতারণায় আচ্ছাদিত এক সমাজে দিনাতিপাত করছি। এমন বৈরি সময়ে যে অল্প সংখ্যক মানুষ তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, পরিশ্রম, ভালোবাসা, মহানুভবতা ও মনুষ্যত্ব প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলী দিয়ে মানব সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ সাধন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাফেজ আবদুল ওয়াহাব।

হ্যাঁ, অতি সাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি, কিন্তু অসামান্য ছিল তার জীবনবোধ। তাই তাকে কেন্দ্র করে রচিত হাফেজ আবদুল ওয়াহাব স্মারকগ্রন্থ একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবন নিঃসন্দেহে একটি অসামান্য গ্রন্থ। প্রথমত, অসামান্য তার মানবতাবাদী চেতনার জন্য; দ্বিতীয়ত, তার জীবনকে উপলব্ধি করার নির্মোহ দৃষ্টিকোণের জন্য; শেষ নাগাদ, এটি অসামান্য তার যাপিত জীবনের সততা ও মহানুভবতার জন্য।

গ্রন্থের সম্পাদক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ ভূঁইয়া তার সম্পাদকীয়তে বলেছেন, ‘একজন সত্যিকারের ভালো মানুষের যত গুণ থাকা দরকার তার সবকিছুই ছিল তার মধ্যে। তিনি ছিলেন নিষ্কলুষ জীবনের অধিকারী। তার মহত্ত্ব ও অবদান পরবর্তী প্রজন্মকে জানানো উচিত।’

আমিও মনে করি, এমন একজন মানুষের জীবন আগামী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় হওয়া উচিত। জানিয়ে রাখতে চাই, হাফেজ আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে পঞ্চাশেরও অধিক ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ লেখা এই গ্রন্থে ছাপা হয়েছে।

হাফেজ আবদুল ওয়াহাব; ছবি : সংগৃহীত

তাছাড়া প্রায় ৮০টির মতো সংক্ষিপ্ত মন্তব্যও বইয়ে স্থান পেয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল আলী মৃধাসহ আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের মন্তব্য।

খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও একজন মানুষ যে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারেন তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন হাফেজ আবদুল ওয়াহাব। জীবন ধারণের জন্য এক সাধারণ যাপন প্রণালী বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

নিজের দর্শনে ধর্মকে স্থান দিয়েছিলেন সর্বাগ্রে, কিন্তু গোঁড়ামি নয়। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই মানুষ জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কৃষিকে। ফলে আতিশয্যকে কখনো প্রশ্রয় দেননি।

ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের আত্মমর্যাদাশীল। নিজের মর্যাদা ভুলণ্ঠিত হয় এমন কাজে কখনো পা বাড়াননি তিনি। শান্তিপ্রিয় আবদুল ওয়াহাব তার গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়ে সবসময় ছিলেন সচেষ্ট।

নিভৃতে মানুষের উপকার করতে পছন্দ করতেন। ‘অহংকার’ শব্দটি তার দর্শনে স্থান পায়নি। নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ খুব একটা না হলেও বুঝতেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল্য। তাই তো তার সুযোগ্য সন্তান ড. আবদুল হাই সিদ্দিকের একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের ক্ষেত্রে তিনি রেখেছিলেন অসামান্য অবদান।

গ্রন্থের শুরুর দিকে আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে লিখেছেন অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া। ‘ক্ষণিকের দেখা; স্মৃতিতে ভাস্বর পিতৃতুল্য ঐ মানুষটি’ শিরোনামের লেখায় তিনি প্রথমেই হাফেজ আবদুল ওয়াহাবকে একজন ‘বিদ্যানুরাগী’ মানুষ হিসেবে অভিহিত করেন।

সন্তান আবদুল হাই সিদ্দিকের বিদ্যার্জনের পাদপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকালে আবদুল ওয়াহাবের সঙ্গে দেখা হয় অধ্যাপক বড়ুয়ার। প্রথম দেখাতেই তিনি আবদুল ওয়াহাবের জ্ঞানপিপাসু অন্তর আবিষ্কার করেছিলেন।

তার জীবনবোধ মূল্যায়ন করতে গিয়ে অধ্যাপক বড়ুয়া বলেন, ‘আজকাল আত্মবৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। অপরকে নিজের মতো ভাবা, দেখা এবং অনুভব করাই হলো আত্মীয়তার লক্ষণ।’

অতএব, অধ্যাপক বড়ুয়া ওয়াহাব সাহেবকে আত্মীয় হিসেবেই দেখেছেন। সবশেষে, তার লেখায় তিনি হাফেজ আবদুল ওয়াহাবকে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ হিসেবে অভিহিত করেন। সেই সঙ্গে আরও বলেন, ‘তাঁর জীবন-দর্শন ও প্রাপ্তির উচ্চতায় আমার এই নিবেদন অতি ক্ষুদ্র, অতি সামান্য।’

একজন মহৎপ্রাণ মানুষ সম্পর্কে অধ্যাপক বড়ুয়ার এমন উক্তি আমাকে অনুপ্রাণিত করে, আলোর পথের যাত্রী হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, ‘বড় মনের একজন সাদামাটা মানুষ’ শিরোনামে অধ্যক্ষ মুহম্মদ নুরুল ইসলাম খান-এর লেখায় তিনি হাফেজ আবদুল ওয়াহাবকে একজন পরোপকারী, শিক্ষানুরাগী, বিনয়ী ও নিরহংকারী মানুষ হিসেবে অভিহিত করেন।

এবারে বলি, স্বপ্নদ্রষ্টা হাফেজ আবদুল ওয়াহাবের কথা। স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল ওয়াহাবকে জানতে গেলে আপনাদের পড়তে হবে ‘আবদুল ওয়াহাব চাচাজীর মহাত্ম্যগাথা মধ্যপাড়া আদর্শ ইসলামিয়া মাদ্রাসার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন যিনি’ শীর্ষক লেখাটি। লিখেছেন মো. আজিজ রহমান মাস্টার। এতে উঠে এসেছে কীভাবে স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতেন আবদুল ওয়াহাব সেই বিষয়টি।

গ্রামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনায় তিনি ছিলেন সদা সক্রিয়। লেখাতেই উল্লেখ আছে, তিনি ছিলেন মধ্যপাড়া আদর্শ ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা। এই প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, পরমাণু বিজ্ঞানী এ. পি. জে. আবদুল কালাম-এর একটি কথা খুব মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি এমন মানুষটিকে বেছে নাও যিনি স্বপ্নকে ভালোবাসেন এবং তা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন।’

হ্যাঁ, হাফেজ আবদুল ওয়াহাব স্মারকগ্রন্থটি পড়ে উক্ত বাক্যটির প্রায়োগিক দিকটি ভালোভাবে অনুধাবন করেছি। আবার হাফেজ মাওলানা তাজুল ইসলাম তার লেখায় আবদুল ওয়াহাব সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি ছিলেন উদার প্রকৃতির একজন সাদা মনের মানুষ। সহজ-সরল ও সৎ জীবন তাকে অনেক উঁচু জায়গায় নিয়ে গেছে। তিনি সফল জীবনের অধিকারী।’

এই পর্যায়ে আবদুল ওয়াহাবকে নিয়ে ছেলে ফখরুল হাসানের কথা। ‘আমার বাবার ধন ছিল সীমিত, মন ছিল অনেক বড়’ শিরোনামের লেখায় একজন আদর্শবান ও নীতিবান বাবার মুখচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার বাবার ভাবনা ও দর্শন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বাবারই একটি চিন্তাকে প্রকাশ করেন এভাবে—‘সন্তানের ছোট ছোট ভুলগুলো ধরিয়ে না দিলে, সবসময় সন্তানের পক্ষ নিলে তা সন্তানের নৈতিক আর চারিত্রিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।’ সহজেই বোঝা যাচ্ছে, এমন চিন্তা যিনি মনে লালন করতেন তিনি নীতিপরায়ণ না হয়ে পারেন না।

আবার রেজাউর রহমান সোহাগ ও তৌহিদুল ইসলাম তাদের লেখায় অতিথিপরায়ণ হাফেজ আবদুল ওয়াহাবকে তুলে ধরেন। তাদের মতে, ড. আবদুল হাই সিদ্দিকের মতো বড় মনের মানুষের বাবা ধনের দিক থেকে গরিব হলেও মনের দিক থেকে অনেক ধনী।

একইভাবে হারুন জামিল হাফেজ আবদুল ওয়াহাব’কে ‘ইসলামের বাস্তব অনুসারী’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার কথায়, ‘ইসলামের অনুশাসন পালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান।’

বাদল বেঞ্জামিন তার লেখায় হাফেজ আবদুল ওয়াহাবকে ‘উত্তম সেবক ও পথ প্রদর্শক’ হিসেবে অভিহিত করেন। পরিমল সূত্রধর তার লেখায় বলেন, ‘বড় ডিগ্রি বা বড় পদ থাকলেই মানুষ বড় হয় না। মানুষ বড় হয় তার নিজস্ব চরিত্র গুণে। সততা ও মানবিক গুণ একজন মানুষকে সত্যিকারের আদর্শ মানুষে রূপান্তর করে। হাফেজ আবদুল ওয়াহাব একজন সাধারণ মানুষ হয়েও সকলের কাছে সম্মানিত হয়ে উঠেছিলেন তার সৎ গুণের কারণে।’

মাওলানা জুনাইদ আহমদ তার লেখায় বলেন, ‘ইসলামই পরিপূর্ণ জীবন বিধান এই সত্য দর্শনকে মেনেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেন।’

গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে প্রতিভা প্রকাশ। গ্রন্থটি নানা যৌক্তিক কারণে আগামী প্রজন্মের পাথেয় হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস করি।

তুষার তালুকদার ।। লেখক ও গবেষক, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।