উন্মুক্ত স্থানে গোসলের ফলে অনিরাপত্তায় ভোগেন ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোরী ও নারীরা। দিনে কিংবা রাতে, তাদের পানি আনতে হয় দূর থেকে। টয়লেট-গোসলখানায় দরজার লক, ওপরের ছাদ না থাকায় যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির ঝুঁকিতে থাকেন সারাক্ষণ। সম্প্রতি এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

শনিবার (১১ জুন) ঢাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

জরিপের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির ওয়াশ স্পেশালিস্ট এস এম তারিকুজ্জামান।

নিজের বক্তব্যে তিনি বলেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এমপাওয়ারিং গার্লস ফর ইকোনমিক অপরচুনিটি অ্যান্ড সেফ স্পেস- ই গ্লস নামক একটি মডেল প্রজেক্ট শুরু করে জানুয়ারি ২০২২ এ। এই প্রজেক্টের আওতায় ঢাকা শহরের চার কলোনি- ধলপুর, মালেক মেম্বর কলোনি, আই জি গেট কলোনি এবং ম্যাচ কলোনিতে ১৫টি গোসলখানা স্থাপনের কাজ করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি)।

পাশাপাশি আমরা এই চার কলোনির মানুষদের, বিশেষ করে মেয়েদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করি, যেখানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪১৭ জন মেয়ে উত্তরদাতা হিসেবে ছিলেন এবং ১২টি ফোকাসড দলীয় আলোচনা করা হয়। এই সমীক্ষা এবং তিন মাসব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন করার উদ্দেশ্যে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন বিওয়াইএস নামক একটি যুব সংগঠন।

কী ধরনের গোসলখানা ব্যবহার করা হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে ৯৮ শতাংশ নারীই উত্তরে বলেছেন, তারা উন্মুক্ত গোসলখানা ব্যবহার করে থাকেন নিত্যদিন। এ উন্মুক্ত গোসলখানার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ গোসলখানায় রয়েছে নারীদের জন্য পৃথক জায়গা, অর্থাৎ শুধু নারীরাই সেখানে গোসলের কাজ সারেন।

প্রতিটি গোসলখানার বিপরীতে ব্যবহারকারীর সংখ্যা গড়ে ৩৫ থেকে ৪৫ জন। সর্বোচ্চ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ এবং সর্বনিম্ন ২০।

এর ব্যবহারকারী নারীরা জানিয়েছেন, এই গোসলখানাগুলো তাদের জন্য নিরাপদ না। আশেপাশের উঁচু দালানকোঠা থেকে ছবিগ্রহণের মত ঘটনাও ঘটে। তারা রাতে টয়লেটে যেতে ভয় পান এবং ৬৮.৬ শতাংশ কিশোরী ও যুব নারীরা বলেন, যে তারা টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো না কোনো সময় সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

তিনি বলেন, চার কলোনির টয়লেট বা গোসলখানায় কোথাও স্যানিটারি সামগ্রী নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা নেই ঠিকমত। এই অবস্থায় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা বেশ কঠিন।

সহিংসতার কথা বলতে গিয়ে অনিরাপদ গোসলখানার ব্যবহারকারী মেয়েরা উল্লেখ করেছেন, যে তারা বেশ দূর থেকে পানি আনতে যান এবং ৫৮.৭ শতাংশ বলেছেন তাদের অনেক বেশি সময় লাগে ও সন্ধ্যা হয়ে যায় এ কাজটি করতে গিয়ে। ৩৮.২ শতাংশ কিশোরী ও যুব নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। ৭৯.২ শতাংশ নারী মৌখিক সহিংসতার শিকার ও ১৩.৪ শতাংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মানিক কুমার সাহা বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজারের মত নিম্ন আয়ের এলাকা রয়েছে। জমির অপ্রতুলতার পাশাপাশি সুয়ারেজ লাইনের চ্যালেঞ্জও এখানে বিদ্যমান। আর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে কিশোরী ও যুব নারীদের ওপর। নিরাপদ গোসলখানার অভাবে পুরুষ ও নারীদের একই সঙ্গে গোসলের কাজ সারতে হয় বলে, গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হয়। সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকে।

তিনি বলেন, ঢাকার ৪টি কলোনিতে আমরা আমাদের প্রকল্পের আওতায় ১৫টি গোসলখানা নির্মাণ করেছি, যার মধ্যে ২টি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। আমরা আশা করি, কিশোরী ও নারীরা এগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাবে কিছুটা হলেও।

মানিক কুমার সাহা আরও বলেন, কিন্তু নিরাপদ গোসলখানার চাহিদা আরও বেশি। নীতিনির্ধারক মহলকে আমরা এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাই যেন আমরা সবাই একত্রে এই সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে কাজ করা। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের বাজেটে কীভাবে এই ইস্যুকে গুরুত্ব দেওয়া যায় তা নিশ্চিতেও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।

পিএসটিসি থেকে প্রকল্প সমন্বয়কারী শিরোপা কুলসুম বলেন, একটি গোসলখানায় যখন এতোগুলো মানুষ গোসল করে, তাদের চাহিদা পূরণে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। নারীদের ওপর এর প্রভাব আরও বেশি। বিশেষ করে মাসিকের সময় সংকট হয়ে দাঁড়ায় অভাবনীয়। মাসিক ব্যবস্থাপনা কষ্টকর হওয়ায় তৈরি হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও। সহিংসতার ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতেও প্রয়োজন নিরাপদ গোসলখানা।

বিওয়াইএস এর প্রতিষ্ঠাতা ফায়েজ বেলাল বলেন, গোসলখানার নিরাপত্তা কতটা জরুরি তা আমরা অনেকেই বুঝি না। এই প্রকল্পে কাজ করার মধ্য এই উপলব্ধিটি সর্বপ্রথম আমার মধ্যে কাজ করে। একজন কিশোরীর নিরাপত্তা থেকে শুরু করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে কমন এবং অনিরাপদ গোসলখানা ও টয়লেট নিয়ে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগী কিশোরী নিশাত।

তিনি বলেন, ‘পৃথক গোসলখানার অভাব আমাদের জন্য একটা অস্বস্তির বিষয়। মৌখিকভাবে হয়রানি হতে হয়। মাসিকের সময় আমরা প্রয়োজনীয় সময়টাই পাই না নিজেদের হাইজিন ম্যানেজ করার।’

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার সেমন্তি মঞ্জরি জানান, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ শিশু, কিশোর-কিশোরী ও যুব, বিশেষ করে যুব নারীদের, উন্নয়নে কাজ করে। তার কাজের মধ্য দিয়ে জেন্ডার সমতার দিকে এই যাত্রা অব্যাহত থাকবে। গত ১০ বছর আমরা সহিংসতার ভয় প্রতিরোধে কাজ করে চলেছি। নিরাপদ গোসলখানার উদ্যোগ এই কার্যক্রমের একটি অংশ। আমাদের এই কাজ শুরুর একটি পদক্ষেপ মাত্র।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সেন্ট্রাল অ্যান্ড নর্দান রিজিওনের প্রধান আশিক বিল্লাহ জানান, শিশুদের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের মধ্যদিয়ে তাদের ও তাদের কমিউনিটির জীবন মান উন্নয়নে কাজ করছি আমরা। এ পর্যন্ত ৩১৩৫ জন স্পন্সরশিপ শিশুদের কাজ করছে। নিরাপদ গোসলখানা তাদের কেন্দ্র করেও পরিচালিত হয়েছে।

জেইউ/এসএম