জনতার ঢল নেই ভাষাশহীদদের সমাধিতে
যে ভাষার স্মৃতির কাছে চিরঅম্লান বাঙালির জাতিসত্তা, সেই ভাষা রক্ষার দিনে শোক, বেদনা, গর্ব আর দীপ্তিমান সূর্যের প্রখরতা নিয়ে সব মত পথ যেন এক হয়েছে শহীদ মিনারে। প্রভাতফেরির পথে কণ্ঠে বাজছে এক সুর- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’
তবে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনতার ঢল নামলেও এদিনে যাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ সেসব মৃত্যুঞ্জয়ী বীর আজিমপুরের পুরাতন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত ভাষা শহীদ আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার ও শফিউর রহমানের সমাধিতে জনতার ঢল নেই। নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তোবা জানেও না কোথায় চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা! আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানের দক্ষিণ গেট দিয়ে প্রবেশ করে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে কালো টাইলসে বাঁধাই করা পাশাপাশি সমাহিত তিন ভাষাশহীদের কবর।
বিজ্ঞাপন
প্রথম কবরটি শহীদ আবুল বরকতের। বরকতের পাশেই কবি সুফিয়া কামালের কবর। তার একটু দূরে শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রহমানের কবর। বরকতের তিনটা কবর পরেই আব্দুল জব্বারের কবর। সেটিও কালো রঙের টাইলস দিয়ে বাঁধানো। তার তিন সারি সামনে খানিকটা সরু পথ পেরুলে আরেক ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের কবর। প্রতিটি কবরের পশ্চিম দিকে সাদা মার্বেল পাথরের ফলক। তাতে লেখা রয়েছে নাম-পরিচয়, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ।
অবশ্য এ তিন ভাষা শহীদ ছাড়াও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম, অহিউল্লাহ ও আবদুল আওয়ালকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) লাশ দাফনের খাতায় অহিউল্লাহর নাম পাওয়া গেলেও তার কবর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সালাম ও আওয়ালের কবরেরও নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন। ভাষা শহীদ রফিকের মরদেহও অতি গোপনে দাফন করা হয়েছিল কবরস্থানের অসংরক্ষিত এলাকায়। এরপর এ কবর ভেঙে ফেলে নতুন কবর বসানো হয়ে। আজও তার কবরটির কোনো চিহ্ন আবিষ্কার হয়নি।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) বেলা বারোটায় সরেজমিনে দেখা গেল, তিন ভাষা শহীদের কবরের ওপর হাতেগোনা কয়েকটি ফুলের ডালার শ্রদ্ধার্ঘ্য। ভাষা শহীদের পরিবার, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে গুটিকতক শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়েছে।
শহীদ শফিউর রহমানের কবরের পাশে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর পর কবর জিয়ারত করতে দেখা গেল ‘প্রজন্ম ২০০১’ নামের একটি সংগঠনের লোকজনকে। হাসিবুর রহমান নামে একজন বললেন, আমরা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানিনা ৫২-র ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া মহান ব্যক্তিদের জীবনী সম্পর্কে। এটা জাতি হিসেবে হতাশাজনক। আজকের এ দিনে সবাই যেমন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটছে, তেমনি উচিৎ ভাষা শহীদদের জীবনী সম্পর্কে জানা। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব শহীদদের জীবনী পাঠ্যবইয়ে সংক্ষিপ্ততা পরিহার করে বৃহৎ পরিসরে ধারাবাহিকভাবে যুক্ত করা উচিৎ। এতে করে তরুণরা আত্মদানকারী এসব শহীদদের সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে।
বাবার কাছে গল্প শুনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘুরে ভাষা শহীদদের কবর দেখতে এসেছে গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়াজ। সঙ্গে রয়েছে তার সহপাঠী সঞ্জয়। রিয়াজ জানালো, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে সবাই শহীদ মিনারে সে কথা জানতাম কিন্তু শহীদদের কবর আজিমপুর কবরস্থানে রয়েছে তা জানতাম না। গতকাল রাতে বাবার কাছে শুনেছি। তাই আজ দেখতে চলে আসলাম।
রাজধানীর উত্তরা থেকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবর জিয়ারত করতে এসেছেন বেসরকারি বিশ্বিবিদ্যালয় শিক্ষার্থী সালেহীন আহমেদ। বললেন, নতুন প্রজন্মের অনেকেই শহীদদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী জানে না। এমনকি কোথায় তাদের দাফন হয়েছে তাও জানে না। আর ভাষা শহীদদের কবরে আসার চেয়ে মানুষের মধ্যে শহীদ মিনারে যাওয়ার আগ্রহটা অনেক বেশি। আর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আসা সংগঠন এবং মানুষের আগ্রহ যেন সেলফি আর ছবির প্রতিই বেশি!
আজিমপুর কবরস্থানের মালি মফিদুল ইসলাম জানান, এমনিতে সারাবছর ভাষাশহীদদের কবরে লোকজন খুব একটা আসে না। তাদের কবর এখানে যে আছে, এ কথাও অনেকে জানেও না। মাঝেমধ্যে শহীদদের অনেক আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করতে আসেন। তবে আনুষ্ঠানিকতা শুধু এ একদিনই। একুশে ফেব্রুয়ারি দিন যারা শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসেন তাদের কেউ কেউ ভাষা শহীদদের কবরেও আসেন।
২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকেই কবরস্থানের উত্তর দিকের গেটে (নিউ মার্কেট সংলগ্ন) ও দক্ষিণ দিকের গেট খোলা থাকে। ২০ তারিখ রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ভাষা শহীদদের কবরে ফুল দেওয়া শুরু হয়। ২১ তারিখ দিনভর চলে এ শ্রদ্ধা নিবেদন।
এসএম