আর বসা হলো না মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে
২০১৮ সালে যুদ্ধশিশু বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে
২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। দুপুর বেলা। রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সিনেপ্লেক্স হলে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু বিষয়ে আলোকপাত অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আয়োজক ‘উদ্যোগ ঢাকা’। অনুষ্ঠানের সহযোগিতায় ছিল ‘স্বনন’-এর শিল্পীকর্মীরা। আগেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ‘স্বনন’-এর অন্যতম কর্ণধার, বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী রূপা চক্রবর্তী, কানাডা প্রবাসী যুদ্ধশিশু গবেষক মুস্তফা চৌধুরীও।
উপস্থিত হয়েছিলেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আয়োজক প্রতিষ্ঠানের মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে শীতদুপুরেও আমার ঘাম ঝরছিল। কেননা, এখনও এসে পৌঁছাননি সৈয়দ আবুল মকসুদ। বাসা থেকে তাকে আনার জন্য গাড়ি নিয়ে সেখানে বহু আগেই হাজির হয়েছেন শুভাকাঙ্ক্ষী শরীফুল আলম পলাশ।
বিজ্ঞাপন
ফোন দিলাম অনুষ্ঠানের সভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদকে। বললেন, ‘বাসা থেকে রওনা দিয়েছি’। তীব্র যানজটে তারও ঘাম ঝরছে বলে জানান। যানজট ঠেলে ঘাম ঝরিয়ে তিনি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। দেরি হচ্ছে বলে নিজেই অনুষ্ঠান শুরুর অনুমতি দেন। শুভ্র বসন পরিহিত সবার আপনজন ‘মকসুদ ভাই’ যখন মঞ্চে এলেন তখন অনুষ্ঠানে যোগ হলো নতুন মাত্রা।
তার উপস্থিতিতে প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে পুরো মিলনায়তন। যেন প্রবীণ এ মানুষটির কাছ থেকে অন্য আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। কথার পিঠে কথা কীভাবে যোগ করে বলতে হয়, তখন সবাই তা শুনছিলেন, অনুভব করছিলেন।
বিজ্ঞাপন
একাত্তর সালে ও এর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধশিশুদের অবস্থা নিয়ে বর্ণনা দিলেন তিনি। জানালেন, সেই চিরসত্য; যুদ্ধশিশুদের অভিভাবক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধশিশুদের সম্মান রক্ষার জন্য সরকার কী করতে পারে? পরামর্শ দিলেন এ বিষয়েও। সবার প্রিয় সৈয়দ আবুল মকসুদ কথা বলছিলেন, সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে সবার সঙ্গে ছবি তুললেন। শিশুদের ডেকে যখন ছবি তুলছিলেন, তখন তার যে আনন্দ হচ্ছিল সেটা মুখভঙ্গিতেই প্রকাশ করলেন। অনুষ্ঠান শেষ হলো সন্ধ্যায়। গাড়ি ডেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে তার ধানমন্ডির বাড়ির সামনে যাওয়ার আগেই বললেন, ‘আরও একটি বাসায় যেতে হবে। নামিয়ে দাও।’
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ওই বাড়ির দিকে ছুটে চলছিলেন হেঁটে। কী রাতে, কী সকালে, কী বর্ষায়, কী খরতাপে তিনি ছুটতেন! ছুটতেন প্রতিশ্রুতি রক্ষায়।
২০১১ সালের শেষের দিকে মহাসড়কে বিপর্যয় নেমে এল। নাগরিক সমাজের পাশে দাঁড়ালেন তিনি। সড়কে প্রাণহানি? তিনি সড়কে দাঁড়ালেন। সড়কে বিশৃঙ্খলা? তিনি দাঁড়ালেন। তিনি চাইতেন, মানুষ একত্র হলে শৃঙ্খলা আসবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও তিনি ছুটে গেছেন অনেক স্থানে। সড়কে বিশৃঙ্খলারোধের সভায় সরকারের পক্ষ থেকে সৈয়দ আবুল মকসুদকেও রাখা হতো।
কারণ সৈয়দ মকসুদ আবুল মকসুদ যুক্তিসহ কথা বলতেন। কিন্তু মানুষের মঙ্গলের জন্য এত কথা বলা লোকটার মুখ বন্ধ হয়ে গেল একেবারে। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছিলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি বিশেষ নাগরিক সংগঠন গড়বেন, আমাকে কিছুদিন আগেও বলেছেন। বৈঠক করবেন। কিন্তু আর সেই বৈঠকে বসা হলো না।’
চলে গেলেন আমাদের সবার প্রিয় ‘মকসুদ ভাই’। মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান কলামিস্ট, গবেষক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
পিএসডি/এফআর