রাজধানীর মগবাজার রেলক্রসিংয়ে তিন শিফটে ১২ জন গেটম্যান দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেনের তথ্য জানার জন্য তাদের বিশ্রাম কক্ষের সামনেই রাখা আছে টেলিফোন। অথচ সেই টেলিফোনের সঙ্গে নেই দুই পাশের কোনো স্টেশন মাস্টারের 'সংযোগ'। ট্রেন এলে রেললাইনে বিশেষভাবে স্থাপিত ক্যাবলের মাধ্যমে এক কি.মি. দূর থেকে পাওয়া সংকেতে নির্ভর করতে হয় তাদের। কিন্তু বৈদ্যুতিক সেই সংকেতের তার কাটা পড়লে বা নষ্ট হলে সংকেত পান না গেটম্যানরা।

বিশেষ করে এই সমস্যা হয় শুক্রবার-শনিবার। কারণ এ দুদিন প্রধান সংকেত এবং টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী বিভাগের কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটিতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে গেটম্যানদের তাকিয়ে থাকতে হয় রেললাইনের দুই দিকেই। অনেক সময় খুব কাছে ট্রেন আসা দেখে তড়িঘড়ি করে ফেলতে হয় রেলক্রসিং বেরিয়ার।

রাজধানীর অন্তত তিনটি রেলক্রসিংয়ের গেটম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই তথ্য।

দেশের রেলপথে দুই হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ এক হাজার ৩৬১টি। অর্থাৎ প্রায় ৪৮ শতাংশই রেলক্রসিং অবৈধ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ৩৩টি ক্রসিং কে বা কারা ব্যবহার করছে, তা কেউ জানে না। এছাড়া বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতে নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়ায় রেলক্রসিংয়ে মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জনের প্রাণ হারানোর পর ‘সেভ দ্য রোড জানিয়েছে, রেলপথে দুর্ঘটনায় গত সাত মাসে ১৭৮ জন মারা গেছেন। এসময় ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৫২টি। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে ক্রসিংয়ে দায়িত্বে থাকা গেটকিপারদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে।

আরও পড়ুন : রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত?

সংস্থাটির দাবি, দেশের রেলপথে দুই হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ এক হাজার ৩৬১টি। অর্থাৎ প্রায় ৪৮ শতাংশই রেলক্রসিং অবৈধ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ৩৩টি ক্রসিং কে বা কারা ব্যবহার করছে, তা কেউ জানে না। এছাড়া বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতে নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিং। এরমধ্যে ২৩টিরই নেই অনুমোদন। প্রতিদিনই অনেকে অসতর্কতা, অনেকে ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করছেন রেলক্রসিং। যদিও রেলওয়ে আইন অনুযায়ী ট্রেন আসার সময় কিংবা চলাচলের মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট রেল লাইনের দুই পাশেই ১০ ফুট পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি থাকে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা কমাতে ২০১৫ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম) ও রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে (রাজশাহী) আলাদা দুটি প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। এই দুটি প্রকল্পের আওতায় ৭০২টি স্থানে রেলক্রসিং প্রতিবন্ধক, পাহারাদার ঘর নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা। এছাড়া এসব রেলক্রসিংয়ে এক হাজার ৫৩২ জন পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন : রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?

তবুও নিরাপদ হয়নি রেলক্রসিং। ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ২২১ জন। এর মধ্যে ১৮৭ জনই প্রাণ অবৈধভাবে রেল ক্রসিং এলাকা পারাপারে।

সোমবার (১ আগস্ট) রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিংয়ে কর্তব্যরত ৬ জনের সঙ্গে কথা হয়। 

তারা জানান, এফডিসি মোড় থেকে মগবাজার কিংবা মগবাজার থেকে সর্বোচ্চ মগবাজার কাঁচাবাজার রেলগেটে কর্তব্যরত গেটম্যানদের ফোন করে জানানো সম্ভব হয় ট্রেন আসার তথ্য। এই তিন রেলক্রসিং এলাকা খুব কাছাকাছি, যে কারণে টেলিফোন করতে করতে ট্রেনই পৌঁছে যায় সংশ্লিষ্ট রেলগেটে।

তারা বলছেন, নিকট দূরত্বে ট্রেন আসছে, এটা জানার একমাত্র ভরসা বৈদ্যুতিক সংকেত। সেই সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রসিং বেরিয়ার ফেলে ট্রেন চলাচল নিরাপদ করা হয়। কিন্তু বিপত্তি তৈরি হয় যখন রেললাইনে বিশেষভাবে স্থাপিত ক্যাবল নষ্ট হয়ে যায় তখন। কারণ তখন ট্রেন এলেও সংকেত আসে না।

আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন গেটম্যান বলেন, টেলিফোনের সঙ্গে স্টেশন মাস্টারদের কোনো সংযোগ নেই। বৈদ্যুতিক সংকেত লাইন যদি কখনো কাটা পড়ে অথবা কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন সংকেত আসে না। এটা খুবই বিপজ্জক হয়। তখন পরিস্থিতি বুঝে আমরা লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ট্রেন আসার ছবি দেখলে বা নিকট দূরত্বের রেলগেট থেকে টেলিফোন আসা মাত্র ক্রসিং বেরিয়ার ফেলি।

তারা বলেন, এই সংকেত না আসার ঘটনা যদি শুক্রবার-শনিবার ঘটে তাহলে আরও বিপত্তির। শুক্রবার-শনিবার তাই আমরা বেশি সতর্ক থাকি। কারণ এ দুদিন রেলের প্রধান সংকেত এবং টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটিতে থাকেন। যে কারণে সংকেত না আসা কিংবা বৈদ্যুতিক সংকেত লাইন নষ্ট হলেও মেরামত করার লোকবল থাকে না। সে খবর দেওয়ারও মানুষ থাকে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান বলেন, এই সমস্যা নতুন নয়। সিনিয়র কর্মকর্তারা জানেন। কিন্তু সমাধান হয় না। কারণ ছুটি তারাও এনজয় করেন। এটা সমাধান করার জরুরি, নতুবা যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। কারণ আমরাও তো মানুষ। অতি সতর্কতার তো বিকল্প নেই। 

নিয়মিত সংকেত লাইন চেক করা, টেলিফোনের বদলে ওয়্যারলেস সিস্টেম চালু করে নিকট দূরত্বের দুই রেলক্রসিংয়ের গেটম্যানের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

এ ব্যাপারে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করেও বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সংকেত এবং টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলীর বক্তব্য মেলেনি।

জেইউ/জেডএস