এত অল্প সময় রোগী দেখে কী বোঝেন চিকিৎসকরা?
সাত মাসের কন্যাশিশু ইসমত আরা আফিয়াকে নিয়ে শনির আখড়া থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসেছেন মা হালিমা আক্তার। পাঁচ দিন ধরে ছোট্ট আফিয়ার জ্বর-সর্দি-কাশি। দুদিন ধরে শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। উদ্বিগ্ন মা শিশুসন্তানকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগের শিশু বিভাগে। তার মতো অনেক শিশু রোগীকে নিয়ে বিভাগের বাইরের বেঞ্চে বসে আছেন মা-বাবাসহ স্বজনরা। এদের কেউ কেউ দুই তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এখানে অপেক্ষা করছেন।
ঢাকা পোস্ট-কে হালিমা খাতুন বলেন, ‘মেয়ের অসুস্থতার কারণে কিছুই ভালো লাগছে না। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। ওষুধেও সারছে না। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এখানে আসা।’
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগের শিশু বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ শিশুদের নিয়ে চিকিৎসক দেখানোর অপেক্ষায় বাবা-মা ও স্বজনেরা। সকাল ৮টা থেকে সেখানে দুজন নারী চিকিৎসক রোগী দেখছেন। তারা দেখবেন দুপুর ২টা পর্যন্ত। এই দুই চিকিৎসক গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী দেখেন। অর্থাৎ দিনে ছয় ঘণ্টায় ২৫০-এর বেশি রোগী দেখেন। তবে অপেক্ষারত রোগীর সংখ্যা আরও বেশি। এক জনের পর সিরিয়াল ধরে ডাকা হচ্ছে অন্য রোগীর স্বজনদের।
হিসাব করে দেখা যায়, বহির্বিভাগে শিশুবিষয়ক এ চিকিৎসকরা দৈনিক ছয় ঘণ্টা রোগী দেখেন। অর্থাৎ ৩৬০ মিনিট। যদি এক জন চিকিৎসক দৈনিক ২৫০ জন করে রোগী দেখেন, তাহলে প্রতি রোগীর পেছনে ব্যয় করেন দুই মিনিটেরও কম।
বিজ্ঞাপন
তবে অল্প সময়ে বেশি রোগী দেখার কারণে চিকিৎসাপত্র ও রোগী দেখার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা উদাসীন বলে অভিযোগ জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা।
নাম না প্রকাশের অনুরোধে এক শিশুর বাবা বলেন, ‘আমার এক বছরের ছেলে ঘুমায় না ঠিকমতো। ২৪ ঘণ্টায় দুই ঘণ্টাও ঘুমায় না। এটা নিয়েই মূলত পরামর্শ নিতে ডাক্তারের কাছে এসেছি। শুনেছি, ঢাকা মেডিকেলে ভালো চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে আসার পর দেখতেছি, ডাক্তার পাত্তাই দিতেছেন না। ডাক্তার তো আগে রোগী বা রোগীর স্বজনদের কথা শুনবেন। কিন্তু শুনছেন না! আমার বাবুর সব সমস্যা না শুনেই শুধু জ্বর কাশির ওষুধ লিখেই বের করে দিলেন। অথচ আমি তো এসব ওষুধ আগে থেকেই খাওয়াচ্ছি। ঘুম কেন হচ্ছে না, সেটার কোনো সমাধানই পেলাম না।’
আরও তিন দিন আগে এখানেই অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে এসেছিলেন মা রেবুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘তখন ঠাণ্ডা জ্বর সর্দির ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু সুস্থ হয়নি বাচ্চা। আজ যখন আবার দেখাতে নিয়ে এসেছি ডাক্তার বাচ্চাকে ভালো করে দেখলও না। বলে দূরে থাকেন, করোনার সমস্যা যাইতেছে। দুই মিনিটও দেখেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগেও আমার বোনের মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম। বাচ্চার নেবুলাইজেশন দরকার ছিল। কিন্তু এখানে না নিয়েছে ভর্তি, না দিয়েছে কোনো পরামর্শ। শুধু বলেছে, এখানে গ্যাস নেই। চিকিৎসা হবে না। মিরপুর শ্যামলী নয় তো মিডফোর্ডে যেতে বলেছিলেন। সরকারি হাসপাতালে এমন অবস্থা তো প্রত্যাশিত না।’
সেখানে পাঁচ বছরের শিশুসন্তান রাফাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা নার্গিস বেগম। তিনি বলেন, ‘সেই সকাল ১০টায় এসেছি। মেয়ের গলা ব্যথা, ফুলে গেছে। সঙ্গে কাশি, চুলকানিও। দেড় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করেও ডাক্তারের চেম্বারেই যেতে পারিনি। লম্বা সিরিয়াল। সিরিয়াল ধরেই যেতে হচ্ছে।’
শিশুকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার অপেক্ষায় মা শেফালী। তিনি বলেন, ‘বাবুকে নিয়ে কয় দিন ধরে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছি। ১৫ দিন ধরে বাবুর কাশি, ভালোই হচ্ছে না। এর আগেও এসেছিলাম, ডাক্তার দেখাইছি। কিন্তু ভালো হচ্ছে না। যে কারণে আজ আবার এসেছি।’
শিশু বিভাগের চিকিৎসকরা বলছেন, আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। অসচেতনতার কারণে ভাইরাল জ্বর-সর্দি কাশিতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। গত এক সপ্তাহ ধরে এ বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে ঠান্ডাজনিত জ্বর সর্দি-কাশির রোগীই বেশি।
যোগাযোগ করা হলে শিশু বিভাগে কর্তব্যরত জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. অনামিকা সাহা ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘শীত শেষে গরম আসছে। এই সময়টা বাচ্চাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভাইরাল ইনফেকশন হয়। এ ধরনের রোগী খুবই বেড়েছে। আমাকে দিনে ২৫০-এর মতো রোগী দেখতে হয়। আমরা এখানে আসা রোগীদের মধ্যে যারা বেশি অসুস্থ বা নিউমোনিয়া পর্যায়ে চলে গেছে তাদের ভর্তির পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া তুলনামূলক ভালো শিশুদের পরামর্শপত্র ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।’
ডা. অনামিকা আরও বলেন, ‘এই সিজনাল চেঞ্জের (মৌসুম পরিবর্তন) মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে, জ্বর, ঠান্ডা কাশি, পাতলা পায়খানা, বমি এবং শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। জ্বর এলে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছি। ঠান্ডা কাশিতে প্রথমে ওষুধ না দিয়ে বাচ্চাদের গরম রাখা, গরম পানি ও আদা লেবুর চা খাওয়ানো যেতে পারে। এরপরও ভালো না হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। আর প্রথমেই কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো মোটেও উচিত নয়। পাতলা পায়খানায় স্যালাইন খাওয়াতে হবে। কোনোভাবে ভালো না হলে ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত।’
জেইউ/এফআর