খুলনার দাকোপের বানিশান্তার তিন ফসলি কৃষিজমিতে বালি ও মাটি ফেলে শস্য উৎপাদন ধ্বংস করার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য মোংলা বন্দরের চেয়ারম্যানের অপসারণ ও শাস্তি দাবি করেছেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল।

বুধবার (২৪ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে ৯টি মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন আয়োজিত নাগরিক সভায় তিনি এ দাবি করেন।

সুলতানা কামাল বলেন, উন্নয়ন হলো উপায়। উন্নয়ন কোনো জাতির লক্ষ্য হতে পারে না। লক্ষ্য হবে জনস্বার্থ, মানবাধিকার ও জনকল্যাণ। জনগণের জন্যই উন্নয়ন। আজ কর্তাব্যক্তিরা উন্নয়নকেই লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। জনস্বার্থকে আমরা উন্নয়নের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছি।

তিনি বলেন, জনস্বার্থ বিবেচনা না করে নীতিনির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই উন্নয়ন আমাদের বিপদে ফেলেছে, বিরক্ত করছে। বানিশান্তার আন্দোলনকে বাপা নিজেদের আন্দোলন মনে করে এবং আমরা তাদের পাশে আছি। এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত ও অসদাচরণের জন্য মোংলা বন্দরের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসার অপসারণ ও গ্রেপ্তার দাবি করছি। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় কিন্তু তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আমরা অনতিবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি।

আরও পড়ুন: সিটি করপোরেশনের অসহযোগিতায় অধিকাংশ ডিএমএ চালু করা যাচ্ছে না

নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, দেখানোর জন্য উন্নয়ন করা হলে সেটি উন্নয়ন নয়। জনগণের ক্ষতি করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে সেটি জনস্বার্থবিরোধী এবং এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী কৃষির উন্নয়নের কথা বলেন। কিন্তু এসব নীতিনির্ধারকেরা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবজ্ঞা করছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা এগুলো করতে স্পর্ধা দেখান।

খুশী কবির বলেন, সবাই গণতন্ত্র বলতে শুধু সঠিকভাবে ভোট দেওয়াকে মনে করে। যাদের নির্বাচিত করা হয়, তারা জবাবদিহি করবে কি না সেটা দেখা হয় না। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি না থাকায় তারা বিভিন্ন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, উপকূলীয় জেলা খুলনা একটি কৃষিপ্রধান জেলা। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর নদী ড্রেজিং সংক্রান্ত ‘মোংলা বন্দর ইনারবার ড্রেজিং’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের অধীন পশুর নদীর ড্রেজিং করা বালুমাটি ফেলার জন্য ১০০০ একর জমি হুকুম দখলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলাধীন বানীশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর তিন ফসলী উর্বর কৃষিজমি। বানীশান্তার কৃষিশ্রমিককে সুরক্ষিত রাখতে এবং কৃষিব্যবস্থা উন্নততর করার উদ্দেশে সরকার বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় বানীশান্তাসহ ৩৩ নম্বর পোল্ডারে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ থেকে কোস্টাল এমব্যান্ডমেন্ট ইরিগেশন প্রকল্পের আওতায় বাঁধ দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বানীশান্তায় এখন তিন ফসল আবাদ হচ্ছে।

তিনি বলেন, এ কৃষি জমিতে আষাঢ় থেকে পৌষ মাসে আমন, পৌষ থেকে বৈশাখ মাসে তরমুজ, বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আউশ ধান ও অন্যান্য রবিশস্য চাষ করা হয়। মাটি ফেলার জন্য প্রস্তাবিত জমিতে শুধু শস্য চাষই ব্যাহত হবে তা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে এলাকার প্রান্তিক মানুষদের জীবন-জীবিকার অন্যতম সংস্থান পুকুর, জলাশয়, মৎস্য সম্পদ ও গবাদি প্রাণী।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ফল হিসেবে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হবে অন্তত ১৫০০ ধর্মীয় সংখ্যালঘু-সনাতনী ধর্মের পরিবার। ক্ষতিগ্রস্তরা জেলা প্রশাসনকে জানালে প্রশাসন তাদের পক্ষে মত দেয়। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বানীশান্তা এলাকার তিন ফসলি কৃষিজমিতে পরবর্তীতে মাটি ভরাটের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তীব্র জনরোষের সৃষ্টি হয়।

তিনি আরও বলেন, এলাকাবাসী নদী ড্রেজিংয়ের বিপক্ষে নয়। কিন্তু তা কৃষকের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এবং একটি কৃষিব্যবস্থা ও সমাজ ভেঙে দিয়ে হতে পারে না। বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই বছরের জন্য উর্বর কৃষিজমি হুকুম দখলের প্রস্তাব করলেও বাস্তবতা হচ্ছে মাটি ভরাটের পর এ জমি আর কোনো কৃষি কাজের উপযোগী থাকবে না। ড্রেজিং করা মাটি, পলি মাটি বানীশান্তার হুকুমদখল করা জমিতে ফেললে সে জমি উর্বর হবে এবং কৃষক সে মাটি বিক্রি করে লাভবান হবে— এমন দাবি সম্পূৰ্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। গত ২০১১ এবং ২০২১ সালে চিলাতে ফেলা মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ড্রেজিংয়ের মাটিতে ফসল তো দূরে থাক, কোনো আগাছাও হয়নি। চিলার মতো বানীশান্তাতেও মাটি ফেললে এলাকার জনগোষ্ঠী জীবন ও জীবিকা হারিয়ে স্থানান্তরে বাধ্য হবে, যা অসাংবিধানিক ও অসংবেদনশীল।

নাগরিক সভায় বানিশান্তার ভুক্তভোগীরা তাদের সমস্যা ও অভিযোগগুলো বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন।

নাগরিক সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ, শামসুল হুদা, মনীন্দ্র কুমার নাথ সোহরাব হোসেন প্রমুখ।

আইবি/এসএসএইচ