ঢাকা শহরের তো বটেই, সারা দেশের বহু মানুষের চিকিৎসার শেষ আশ্রয়স্থল হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। তবে সক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগীর সেবা দিতে গিয়ে একদিকে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সেবা পেতে নাজেহাল হতে হয় রোগী ও তার স্বজনদের। 

গ্রীষ্মের তপ্ত দিনগুলোতে রোগী ও স্বজনদের দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। তাদের মাথার ওপর ফ্যান ঘোরে ঠিকই কিন্তু ফ্যানের বাতাস শরীর পর্যন্ত পৌঁছায় না। ফলে বেশিরভাগ রোগীই নিজ খরচে একটি করে ছোট টেবিল ফ্যান কিনে বেডের পাশে রাখেন, আর যাদের এই ফ্যান কেনার সামর্থ্য নেই তাদের হাতে ওঠে হাতপাখা।   

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বছরজুড়েই থাকে বাড়তি রোগীর চাপ। ওয়ার্ডের বাইরে সিঁড়িতে বা করিডোরেও আশ্রয় নেন রোগীরা। রোগী ও তাদের স্বজনরা মিলে এক জায়গায় অতিরিক্ত মানুষ হয়ে যাওয়ার কারণে গরমের দিনগুলোতে ভয়াবহ এক অবস্থার তৈরি হয় সেখানে।   

আরও পড়ুন : সিএনজি থেকে ফেলা মরদেহ যখন ‘সড়ক দুর্ঘটনা’

 গত সপ্তাহে ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে ছিলেন ভর্তি চট্টগ্রাম থেকে আসা রইসুল ইসলাম। তার ছেলে আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেখছেন তো, ফ্যান ঘুরছে, কিন্তু গায়ে বাতাস লাগে না। গরমে রোগী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। একটা মাল্টিপ্লাগ কিনে ছোট ফ্যান চালিয়ে দিয়েছি বাবাকে।

হাসপাতালের সিঁড়িতে কোনো রকমে শুয়ে ছিলেন সার্জারি বিভাগে ভর্তি রোগী দুলাল হোসেন। তিনি বলেন, আমি মৌলভীবাজার থেকে এসেছি, ১০ দিন হলো হাসপাতালে ভর্তি আছি। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওয়ার্ডে সিট পেয়েও সিঁড়িতে চলে এসেছি। এত গরম ওয়ার্ডের ভেতর! ফ্যান ঘুরলেও গায়ে বাতাস লাগে না। তাই ছোট ফ্যান কিনে এখানে শুয়ে আছি।

দুলাল হোসেনের মতোই আরও এক রোগীকে পাওয়া গেল যিনি ওয়ার্ডে সিট পেয়েও সিঁড়িতে এসে থাকছেন। নিউরোসার্জারি বিভাগে ভর্তি ওই রোগীর স্বজন বলেন, রোগীর অতিরিক্ত চাপ এবং এক রোগীর সাথে পাঁচ-ছয় জন অ্যাটেনডেন্ট থাকায় গরমটা অনেক বেশি হয়। আমরা ইচ্ছা করেই অতিরিক্ত গরমের কারণে সিঁড়িতে চলে এসেছি, এখানে একটু হাওয়া-বাতাস পাওয়া যায়। মাল্টিপ্লাগ দিয়ে লাইন টেনে ফ্যান চালাচ্ছি।

রোগীদের দুর্দশার এ চিত্র নতুন নয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরও অজানা নয়। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের যে শয্যার সংখ্যা, ভবনের যে বিন্যাস, তার চেয়ে অনেক বেশি রোগী এখানে থাকেন। তাছাড়া আমাদের ভবন অনেক পুরাতন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে আধুনিক ৫ হাজার শয্যায় উন্নীত করা হবে। এরই মধ্যে তার নকশার কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটিতে এটি পাস হলে ৫ হাজার শয্যার একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল হবে।   

আরও পড়ুন : সকাল ৯টায়ও আসেননি কোনো ডাক্তার, রোগীদের ভোগান্তি

তিনি আরও বলেন, জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরের কিছুদিন বাংলাদেশে অসহনীয় গরম থাকে। আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার কারণে গরম অনুভূত হয় আরও বেশি। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এই রোগীরা গরমে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক রোগীই পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে আসে, ফলে অতিরিক্ত মানুষ আর ভেন্টিলেশনের অপর্যাপ্ততায় রোগীদের গরমে কষ্ট পেতে হয়। 

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় প্রায় প্রত্যেক বেডেই রোগীরা মাল্টিপ্লাগ দিয়ে একটি করে ছোট ফ্যান চালাচ্ছেন। এভাবে বাড়তি এতগুলো ফ্যান চলার কারণে অতিরিক্ত লোড পড়ে, এতে অনেক সময় সকেট পুড়ে যায়। এমন ঝুঁকি থাকার পর মানবিক কারণে অনেক সময় কঠোর হতে পারে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।  

হাসপাতালের প্রত্যেকটি বেডের সাথে মাল্টিপ্লাগ দিয়ে ফ্যান চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক পরিচালক বলেন, রোগীদের কথা চিন্তা করে আমরা তাদের থামাতে পারি না। আমরা চেষ্টা করি কোনোভাবে যেন শর্ট সার্কিট না হয় এবং বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে। তবে হাজার হাজার মানুষকে মনিটরিং করা কঠিন। এতকিছুর পরও কিছু কিছু সময় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমরা চেষ্টা করছি এগুলো কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, রোগীদের কিভাবে সচেতনা করা যায়।  

হাসপাতালে একজন রোগীর সাথে অতিরিক্ত অ্যাটেনডেন্স থাকার বিষয়ে পরিচালক বলেন, একজন রোগীর সাথে তার পুরো পরিবার চলে আসে। আমাদের যে সংস্কৃতি, আমরা তাদের খুব বেশি কিছু বলতেও পারি না। একটা রোগীর চলাফেরা করতে যে সাপোর্ট প্রয়োজন, সেটা দেওয়ার মতো জনবল আমাদের নেই। এর জন্য আমাদের অ্যাটেনডেন্সের সহযোগিতা নিতে হয়। ধরেন একটা রোগীর পা ভেঙে গেল, ২৪ ঘণ্টা একটা মানুষের সাথে থেকে সেবা করা সম্ভব নয়। একজন দিনে ডিউটি করল, আরেকজন রাতে। কিন্তু যারা গ্রাম থেকে আসে তাদের এখানে তো থাকার জায়গা নেই। আমাদের সবকিছু চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।   

আরও পড়ুন : অ্যাম্বুলেন্স চালকের মৃত্যু, রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তি  

নাজমুল হক আরও বলেন, আমাদের এখানে মার্চ মাসে ফ্যানের সুইচ অন হয় সেটা নভেম্বরে গিয়ে বন্ধ হয়। টানা কয়েক মাস এভাবে ফ্যান চলতে থাকে। এই যে ফ্যানগুলো মার্চ মাসে সুইচ অন হয়েছে, সেগুলো নিজে থেকে কেউ অফ না করলে চলতেই থাকে। আমাদের একটি কোম্পানি ফ্যান ডোনেশন দেওয়ার কথা বলেছিল, আমরা তাদের বলেছিলাম আমাদের এই ধরনের কন্ডিশনের ফ্যান লাগবে। তারা স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আমাদের ডোনেট করেছে। 

তিনি আরও বলেন, আসলে সবাই চায় ঢাকা মেডিকেলে এসে ভালো চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যেতে। এজন্যই আমাদের এখানে রোগীর চাপ বেশি থাকে আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করি তাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে দিতে।

রোগীর স্বজনের ভিড়ের বিষয়ে এই হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করা একজন আনসার সদস্য বলেন, একজন রোগীর সাথে ৪/৫ জন করে স্বজন এখানে থাকে। আমরা বারবার বললেও তারা ওয়ার্ড থেকে বের হতে চায় না।

এসএএ/এনএফ