লালমাটিয়ার সেই বাসা, যেখানে বসবাস করতেন লেখক মুশতাক আহমেদ/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ার ডি ব্লক। বাসা নম্বর ১/৮। নামটাও বেশ সুন্দর; পরম্পরায়। কিন্তু ছয়তলাবিশিষ্ট এ ভবনটিতে যেন সারাদেশের সব নিস্তব্ধতা এসে জড়ো হয়েছে। ভবনের ইট-কাঠের মতো প্রাণহীন যেন ভেতরে থাকা মানুষগুলোও। কারও মুখে কথা নেই। চোখে মুখে বিষাদের ছাপ। যেন গগনবিদারী কান্নায় ফাটছে তাদের বুক।

এ বাসাটিতেই থাকতেন কারাগারে বন্দি অবস্থায় মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ। এখানে বসবাস করছেন তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা। ছয় তলা এ ভবনের তিন তলায় পরিবারসহ থাকতেন মুশতাক। তবে এ ভবনে আর পড়বে না তার পদচিহ্ন। তার মৃত্যুতে নির্বাক পাড়া-পড়শিরাও।

মুশতাকের মতোই চুপসে গেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। কেউ কথা বলতে আগ্রহী নন। সবাই অসুস্থ। মুশতাকের এভাবে চলে যাওয়ার শোকে মুহ্যমান। এলাকায় তার ছিল সম্মানসূচক সুনাম। তিনি প্রায় ৫-৬ বছর ধরে কুমির চাষ করেছিলেন। জীবনসঙ্গী হিসেবে পাশে ছিলেন লীপা আক্তার।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছিলেন মুশতাক। উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে কুমির চাষে মনোনিবেশ করেন। ২০১০ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় তিনি শুরু করেন দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার। মুশতাকের দুই বোন দেশের বাইরে (আমেরিকায়) থাকেন। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে ভাইয়ের মৃত্যুতেও দেশে আসতে পারেননি।

শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে অশ্রুঝরা চোখে লাঠিতে ভর দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে একমাত্র ছেলে মুশতাক আহমেদকে চির নিদ্রায় শায়িত করে এসেছিলেন তার বাবা। ৮৯ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা আবদুর রাজ্জাক ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। কথা বলতে রাজি হলেন না। তবে চোখ দিয়ে যেন সব বলে দিলেন; সব বেদনা অশ্রু হয়ে অনবরত ঝরছে চোখ দিয়ে।

শেষ পর্যন্ত কথা বাসাটির কেয়ারটেকার সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘মুশতাক আহমেদ ছিলেন খুব মিষ্টভাষী, যতবার দেখা হতো খুব নম্রভাবে কথা বলতেন। চলাফেরা ছিল খুবই সাধারণ। এমন একজন ভালো মানুষকে হারিয়েছি আমরা…।’

কারাগারে মৃত্যুবরণ করা এ লেখক প্রসঙ্গে প্রায় একই কথা বলেছেন বাসার সামনে একটি টেইলার্স দোকানের কয়েকজন কর্মীও।

এ লেখকের সাবেক সহকর্মী হাসান ইকবাল বলেন, ‘মুশতাক আহমেদ অত্যন্ত নম্র স্বভাবের এবং শান্তশিষ্ট মানুষ ছিলেন। তার এমন পরিণতি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।’

মুশতাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ফুফাতো ভাই ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘ভাইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার সময় আমাকে শেষ কথা বলছিলেন, টেনশন নিয়ো না। আমি স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসব। মুশতাক ভাইয়ার সঙ্গে অনেকগুলো স্মৃতি আছে। কুমির চাষ করার সময় ভালুকায় তার সঙ্গে একটা স্মরণীয় ঘটনা রয়েছে। কুমিরের কাছে নিয়ে আমাকে বলল এগুলোর উপর হাত দাও। কুমিরগুলো কামড়ায় না। উনি দীর্ঘদিন ধরে কুমির চাষ করতেন। ছাত্র অবস্থা থেকে তিনি লেখালেখি করতেন।’

কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদ বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৮টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে র‌্যাবের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। ১০ মাস ধরে কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। ছয়বার জামিন চেয়েও পাননি। শুক্রবার রাতে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে মুশতাক আহমেদের দাফন সম্পন্ন হয়।

দাফনের পর ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মুশতাকের ৮৯ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে নির্দোষ। বিনা বিচারে দিনের পর দিন কারাগারে থেকে তার মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ এদের বিচার করবে।’

মুশতাক আহমেদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবকিছুতেই বৈচিত্র্য খুঁজতেন তিনি। দেশে প্রথম সফল কুমির খামার গড়ে তোলার পর ‘কুমির ভাই’ হিসেবে বন্ধু আর স্বজনদের মাঝে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ, বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা তরুণদের তথ্য গবেষণার অন্যতম উৎস ছিলেন তিনি।

এদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গাজীপুরের কাশিমপুর উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন কারাগারে বন্দি অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

অন্যদিকে, কারাবন্দি অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) ১৩টি দেশের কূটনীতিকরা যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তারা মুশতাকের মৃত্যুর দ্রুত, স্বচ্ছ, স্বাধীন এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার আহ্বানও জানিয়েছেন।

এএসএস/এমটি/এফআর