এখন নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেই। প্রবাস জীবন এমনিতেই কষ্টের। যারা আসেন, শুধু তারাই জানেন। দেশে ভালো ছিলাম, এখানে এসে এমনভাবে ফেঁসে যাব, কখনও ভাবিনি...

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ছেলে মো. বোরহান আলী (ছদ্মনাম)। বয়স মাত্র ২৩। পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকে ঝোঁক ছিল ফুটবল খেলার। স্বপ্ন ছিল বড় খেলোয়াড় হবেন। খেলবেন দেশ-বিদেশে।

স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবলে লাথি মারা শুরু। ভালো খেলায় প্রায়ই দাওয়াত পেতেন। এখানে-সেখানে ‘খ্যাপ’ খেলতে যেতেন। সময়টা ভালোই কাটছিল। কিন্তু বেশিদিন নয়। খেলাধুলা আর দুষ্টামির মধ্যে সময় পার করা বোরহানের কাঁধে ভর করে সংসারের ঘানি টানার। পাড়ি দেন সুদূর সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাইয়ে।

আরও পড়ুন >> টাকায় অফলোড সিলও মুছে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ

দুরন্তপনার সেই চট্টগ্রাম শহর থেকে দুবাই আসা— মাঝখানে কেটে গেছে প্রায় এক বছর। সময়টা কোনোভাবেই সুখকর ছিল না তার জন্য। দেশে প্রতারণা, বিদেশে প্রতারণা; সবচেয়ে বড় প্রতারণা আপনজনের কাছ থেকে। যাদের ওপর বিশ্বাস রেখে এত দূর পথ পাড়ি, তাদের বিশ্বাসঘাতকতায় চরমভাবে হতাশ বোরহান আলী।

দুবাই এসে জানতে পারলাম পার্টনার ভিসা করতে আট হাজার দিরহাম লাগে। সর্বোচ্চ হলে খরচ পড়ে ১২ হাজার দিরহাম (বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন লাখ টাকা)। তার মানে, দুই ভিসার ক্ষেত্রে আমার কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে। যারা নিয়েছেন তারা আর কেউ নন, আমারই আপনজন। এটাই সবচেয়ে বড় কষ্টের! যাদের বিশ্বাস করলাম, তারাই আমার সঙ্গে প্রতারণা করলো

মো. বোরহান আলী, দুবাই প্রবাসী

দুবাইয়ের ডেরা এলাকায় এলোমেলো ঘোরাঘুরি করতে দেখে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। অনুরোধ করেন নাম প্রকাশ না করার। বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে দুবাইয়ে আসার স্বপ্ন ছিল। তখন থেকে আজ পর্যন্ত সবাই শুধু প্রতারণাই করে গেছে। আমি এখন বেকার। খাই-দাই, আর ঘুরে বেড়াই।’
 
দুবাই আসার আগে ‘কন্ট্রাক্ট’ প্রতারণা

দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বোরহান দ্বিতীয়। বড় ভাই কুয়েত থাকেন। একমাত্র বোনটির বিয়ে হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের সোহাবিল হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণি পাস ছেলেটি পরিবারের সচ্ছলতার কথা ভেবে ২০১৯ সালের শেষের দিকে দুবাই আসার পরিকল্পনা করেন।

অফলোড সিল থাকার পরও অর্থের বিনিময়ে দেওয়া হওয়ায় দুবাই যাওয়ার সুযোগ | ছবি- ঢাকা পোস্ট

ফুপাতো ভাইয়ের পরামর্শে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে একটি ট্রাভেল এজেন্সির শরণাপন্ন হন। ওই এজেন্সি তাকে ভিজিট ভিসা ও টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়। নির্ধারিত দিনে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। কিন্তু দুবাইয়ের ফ্লাইটে চড়ার আগে বিমানবন্দরে তাকে আটকে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ।

আরও পড়ুন >> দুবাইয়েও আছে শ্রমের বাজার, বিক্রি হন বাংলাদেশিরা

নানা প্রশ্ন আর উত্তরের পর বোরহানকে দুবাই যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে পাসপোর্টে ‘অফলোড’ লিখে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা পোস্টকে বোরহান বলেন, বিমানবন্দরে যেতেই ইমিগ্রেশন অফিসার প্রশ্ন করলেন, দুবাই কেন যাচ্ছি, সেখানে কী করব। আমার বাবা কী করেন, বড় ভাই কোথায় থাকেন, থাকব নাকি চলে আসব? উত্তর দেওয়ার পর ‘অফলোড’ সিল দিয়ে আমাকে ফেরত পাঠানো হলো।

বিমানবন্দরে যেতেই ইমিগ্রেশন অফিসার প্রশ্ন করলেন, দুবাই কেন যাচ্ছি, সেখানে কী করব। আমার বাবা কী করেন, বড় ভাই কোথায় থাকেন, থাকব নাকি চলে আসব? উত্তর দেওয়ার পর ‘অফলোড’ সিল দিয়ে আমাকে ফেরত পাঠানো হলো

মো. বোরহান আলী, দুবাই প্রবাসী

তিনি বলেন, বিমানবন্দর থেকে ফিরে সরাসরি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা বলল, ইমিগ্রেশন পুলিশকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে কন্ট্রাক্ট করতে হবে। ওই টাকা দিলাম। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একই বিমানবন্দর দিয়ে ‘অফলোড’ সিল দেওয়া পাসপোর্ট নিয়ে আবারও ইমিগ্রেশন পুলিশের সামনে হাজির হলাম। এবার পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বোরহান। উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। এটাই বাংলাদেশ।

স্বপ্নের শহর দুবাই। প্রবাসীদের আকাঙ্ক্ষা থাকে এ শহরে কাজ করার | ছবি- ঢাকা পোস্ট

আবুধাবি নেমেই প্রতারণার শিকার

বোরহান বলেন, অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে আবুধাবি পৌঁছালেও সেখানে নতুন করে প্রতারণা শিকার হই। কীভাবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেখানে অপেক্ষা করছিল আমার এক চাচাতো ভাই। আমাকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বাড়িতে। সেখানে কোনো কাজের কথা না বলে আদায় করা হয় আরও ৫০০ দিরহাম (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ হাজার টাকা)। আমিরাতের আবহাওয়া বোঝার আগেই প্রায় দেড় লাখ টাকা হাওয়া!

আরও পড়ুন >> আছে আধিপত্য, নেই বাংলাদেশি ফল

ভিজিট ভিসার সুযোগে কর্মস্থলেও প্রতারণা

বোরহান বলেন, পরে ওই চাচাতো ভাইয়ের বাসায় কয়েকদিন ছিলাম। ১৭ জানুয়ারি আবুধাবির একটি দোকানে চাকরি হয়। সেখানে বেতন ধরা হয় ১৬০০ দিরহাম। থাকা, খাওয়া-দাওয়া সব কোম্পানির। কাজ শুরু করতেই শুরু হয় লকডাউন। আড়াই মাস লকডাউন শেষে আবারও শুরু হয় কাজ। কিন্তু মালিক আর বেতন দেননি। বর্তমানে সেখানে পাওনা ২০০০ দিরহাম। অনেক চেষ্টার পরও টাকা আদায় না হওয়ায় অভিমানে আবুধাবি ছেড়ে দুবাই চলে আসি।

দিগুণ মূল্যে ভিসা পরিবর্তনে প্রতারণা

দুবাই এসে ভিজিট ভিসা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করেন বোরহান। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন আপন ফুপাতো ভাই। তার মাধ্যমে ফরেন ইনভেস্টর/ফরেন পার্টনার ভিসা করতে দেন তিনি। এজন্য তার কাছ থেকে ২৭ হাজার দিরহাম (ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকা) নেন ফুপাতো ভাই। বলা হয়, তিন বছরের পার্টনার ভিসা দেওয়া হবে তাকে। কিন্তু পরে স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পান দুঃসংবাদ। যা তিনি কখনও কল্পনা করেননি।

দুবাই শহরের ডেরা এলাকা, এখানেই অধিকাংশ বাংলাদেশি প্রবাসীর দেখা মেলে | ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্টকে বোরহান বলেন, ‘দুবাই এসে জানতে পারলাম পার্টনার ভিসা করতে আট হাজার দিরহাম লাগে। সর্বোচ্চ হলে খরচ পড়ে ১২ হাজার দিরহাম (বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন লাখ টাকা)। তার মানে, দুই ভিসার ক্ষেত্রে আমার কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে। যারা নিয়েছেন তারা আর কেউ নন, আমারই আপনজন। এটাই সবচেয়ে বড় কষ্টের! যাদের বিশ্বাস করলাম, তারাই আমার সঙ্গে প্রতারণা করলো।

আরও পড়ুন >> হার না মানা গল্পগুলো যখন স্বপ্ন দেখায়

বোরহান জানান, তার ফুপাতো ভাইয়ের নাম মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। তিনি এসি-ফ্রিজ মেরামতের কাজ করেন।

আপ্লুত বোরহান বলেন, ‘সব ছেড়ে দিয়ে দুবাই চলে আসি। এখন ডেরাই থাকি। কিছু জমানো টাকা আছে। সেগুলো দিয়ে খাই-দাই, আর ঘুরে বেড়াই। চাকরি নাই।’

এখন কী করবেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেই। প্রবাস জীবন এমনিতেই কষ্টের। যারা আসেন, শুধু তারাই জানেন। দেশে ভালো ছিলাম, এখানে এসে এমনভাবে ফেঁসে যাব, কখনও ভাবিনি। গত দেড় বছরে আট লাখ টাকা খরচ করেছি। আয় করেছি মাত্র এক লাখ টাকা। পরিবার থেকে এতগুলো টাকা নিয়েছি, কীভাবে তুলব? আরও তিন বছর আছি, দেখি ভাগ্যে কী লেখা আছে?’
 
এআর/এমএআর/