মানবিক মোহাম্মদ মহসীন/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

তার ছুটে চলা সর্বত্র। কখনও তিনি লাঠি হাতে সড়কে, কখনও রক্ত দিতে হাসপাতালে। কখনও তাকে দেখা যায় ক্যানভাসারের গাড়িতে। পাঞ্জাবি পরে মাইক্রোফোন হাতে মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে বক্তব্যও তিনি দেন। এসবের একটাই লক্ষ্য- মানুষের আস্থা অর্জন।

বলছি মানবিক এক পুলিশ অফিসারের কথা। নাম তার মোহাম্মদ মহসীন। চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তিনি। দুরন্ত এই ওসির দায়িত্ব পালনের ভৌগোলিক সীমা ১০ মাইল। কিন্তু তার কাছে সহায়তা চাওয়ার ক্ষেত্রে যেন নেই কোনো সীমারেখা।

আইনগত সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা কিংবা পরামর্শ চেয়ে তার কাছে কল আসে ৫৭ হাজার বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মানুষের। কখনও কখনও দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ফোন আসে গ্রিস, ইতালি, কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও। প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনে ভরসার আশ্রয় মনে করেন ওসি মহসীনকে। মানবিক ও ব্যতিক্রমী সব উদ্যোগ নিয়ে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তার কারণে ডবলমুরিং থানায় সারাক্ষণ ভিড় থাকে সহায়তা প্রত্যাশীদের।

ওসি মোহাম্মদ মহসীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি মানুষের আস্থার ঠিকানা হতে চাই। তারা স্বপ্নে যে পুলিশ প্রত্যাশা করে, আমি সেই পুলিশ হয়ে বাঁচতে চাই। শুধু পদাধিকার বলে নয়, হতে চাই জনগণের প্রত্যাশার ওসি। মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে যত নেতিবাচক ধারণা সব মুছে দিতে চাই।’

‘হ্যালো ওসি’
ওসি মহসীনের সবচেয়ে আলোচিত উদ্যোগ ‘হ্যালো ওসি’। মানুষের মাঝে থাকা পুলিশভীতি দূর করতে ওসি নিজেই গিয়েছেন এলাকায় এলাকায়। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট একটি এলাকা ঘুরেছেন। সেখান থেকে মাদক, ইভটিজিংসহ অন্যান্য অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে ধারণা নেন তিনি। সমাধানযোগ্য বিষয়গুলো তাৎক্ষণিক সমাধান করেন। বাকি সমস্যাগুলো নোটবুকে টুকে নেন, পরে তাও সমাধান করে দেন। এই উদ্যোগ পুলিশ- জনতা আস্থার সম্পর্ক তৈরির পাশাপাশি অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধেও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ওসি মহসীনের এই উদ্যোগের ফলে অপরাধ জগত থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন জুনু বেগম, নুরুন্নাহার, পুতুল বেগম, ফাতেমা, লাকি ও সাহিদার মতো অনেকে। এমন সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘হ্যালো ওসি’ বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের ১৬ থানাতেই। এছাড়াও চট্টগ্রামের বাইরে বেশ কিছু থানায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।

শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও ব্যাপক প্রশংসিত হয় উদ্যোগটি। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের একটি প্রতিনিধি দল এ কার্যক্রম পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করে। তারা ইতোমধ্যে ‘হ্যালো ওসি’ মডেলটি বিশ্বের ৩৯টি দেশে প্রদর্শন করেছেন। এ উদ্যোগের জন্য তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পদকে ভূষিত হন। আর উদ্যোগের জনপ্রিয়তায় ওসি মহসীন ‘হ্যালো ওসি’ নামেই পরিচিতি পান।

সুপথে ফেরানোর কারিগর
এই পুলিশ কর্মকর্তা ব্যাপক আলোচিত হন অপরাধীদের সুপথে ফিরিয়ে। তার হাত ধরে সুপথে ফিরেছেন ১৪ মামলার আসামি পাখি, ২১ মামলার আসামি জুলেখা, ১১ মামলার আসামি শাহনাজ বেগম সানু, ৯ মামলার আসামি খালেদা বেগম, ৭ মামলার আসামি রহিমা, একাধিক মামলার আসামি জুনু বেগম, নুরুন্নাহার, পুতুল বেগম, ফাতেমা, লাকি, সাহিদা ও পাকিজা বেগম পাখিসহ অনেকে। তাদের কেউ সেলাইয়ের কাজ, কেউ সবজি বিক্রেতা, কেউ বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ, কেউ মুদি দোকানে কাজ করছেন। কেউ কেউ করছেন গার্মেন্টসে চাকরি।

সুপথে ফিরে আসা চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকার নুরুন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি অন্ধকার থেকে এখন আলোর পথে। ওসি মহসীন স্যার ভালো পথে আহ্বান জানানোর পর আমি আগের অপরাধ জীবন থেকে ফিরে এসেছি।’

ওসি যখন খতিব
সাধারণত শুক্রবার জুমার নামাজের আগে বয়ান করেন নির্ধারিত মসজিদের ইমাম। এটিই স্বাভাবিক এবং প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার মসজিদগুলোতে এ কাজে দেখা যায় ওসি মহসীনকে। প্রতি শুক্রবারই ভিন্ন ভিন্ন মসজিদে গিয়ে বয়ান করেন ইমামের মতোই। তার বয়ানে উঠে আসছে সমাজের বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কে ধর্মীয় অবস্থান। আর এসব বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন কোরআন-হাদিসের আলোকে। ভিন্নধর্মী এ পুলিশিং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে চট্টগ্রামে।

এ প্রসঙ্গে ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘দেশের ৯০ শতাংশ মুসলমানের মধ্যে প্রায় শতভাগ মুসলমানই ধর্মভীরু। তারা অন্য কথার চেয়ে মসজিদের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। আমি অপরাধ দমনে এ সুযোগটাই নিয়েছি। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিভিন্ন অপরাধ- মাদক, ইভটিজিং ও সন্ত্রাস ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করি। এ মসজিদ পুলিশিংয়ের ভালো সুফলও পাচ্ছি।’

এ বিষয়ে পানওয়ালাপাড়া জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘আগে মসজিদের পাশেই স্থানীয় কিশোরেরা ইভটিজিং করত। কিশোররা গ্যাং নিয়ে ঘুরত। কিন্তু ওসি সাহেব মসজিদে একদিন বয়ান করার পরপরই এটা কমে এসেছে।’

ফেসবুক পুলিশিং
ফেসবুকেও ব্যাপক জনপ্রিয় ওসি মহসীন। তার ব্যক্তিনামে পরিচালিত একটি ফেসবুক পেজে অনুসারী রয়েছে প্রায় ছয় লাখ। এছাড়াও তার ফেসবুক আইডিতে দুই লাখ অনুসারী রয়েছে। জনপ্রিয় এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও তিনি পুলিশিংয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন। প্রতিদিনই তিনি আইনগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতনতামূলক স্ট্যাটাস ও ভিডিও আপলোড করেন।

এ বিষয়ে ওসি মহসীন বলেন, ‘ফেসবুককে আমি কখনও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করিনি। এটাকেও আমি পুলিশিংয়ের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছি। এটার সুফলও পেয়েছি হাতেনাতে। একদিন সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইল কেনার আইনগত ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করি। এরপর প্রায়ই আমার কাছে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ এসে পরামর্শ চান পুরাতন মোবাইল, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য কেনার বিষয়ে।’

করোনা হিরো
মানবিকতার চরম সংকটের মুহূর্তে করোনাকালে মানবতার দূত হয়ে হাজির হন আলোচিত এ পুলিশ কর্মকর্তা। রোগীদের পুলিশের গাড়িতে করে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, প্লাজমা সংগ্রহ করে দেওয়া, হ্যালো ডাক্তার, হ্যালো অ্যাম্বুলেন্স, আমার ফার্মেসি, ভ্রাম্যমাণ ইফতার, ভ্রাম্যমাণ বেসিন, করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে খাবার দেওয়া, ডোর টু ডোর শপ, করোনা প্রতিরোধী বাজারসহ ২৪টি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করে মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করেন তিনি। এ সেবা দিতে গিয়ে একপর্যায়ে নিজেও করোনা আক্রান্ত হন ওসি মহসীন।

তিনি বলেন, ‘করোনা আমাদের সুযোগ দিয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, তাদের আস্থা কুড়ানোর। আমরা সে সুযোগ লুফে নিয়েছি। মানুষের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে যখন যে উদ্যোগ প্রয়োজন সেটা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছি। নিজে করোনা আক্রান্ত হওয়ার বিনিময়ে মানুষের মন জয় করেছি।’

মাদকশূন্য এলাকা
বর্তমানে ওসি মহসীন ব্যস্ত মাদকশূন্য এলাকা গড়তে। দেশের প্রথম মাদকশূন্য থানা গড়তে চান তিনি। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ওয়ার্ড, পাড়া, মসজিদ, মন্দির ও বাজারকেন্দ্রিক ১০০টি মাদক প্রতিরোধ কমিটি করেছেন। এলাকাভিত্তিক অভিযানও শুরু করেছেন। নির্দিষ্ট একটি এলাকাকে মাদকশূন্য ঘোষণার মাধ্যমে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন এই ওসি।

কেএম/এসএসএইচ/এইচকে