বাড়ির পাশে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সেখানে নানাভাবে পানি জমে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা ও ডাবের খোলে জমা পানিতেও জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা।

অন্যদিকে, বাসাবাড়িতে থাকা গাছের টব থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে কিংবা আবাসিক এলাকায় উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। কিন্তু এডিস মশার প্রজনন রোধে নেই যথাযথ কোনো ব্যবস্থা।

শনিবার (৮ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা ও শাহজাদপুর এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন? 

সরেজমিনে দেখা যায়, এসব এলাকার রাস্তার দুই পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা রকম পলিথিনের ব্যাগ। সেখানে অল্প বৃষ্টিতে পানি জমছে। জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা।

নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে ও নিচে, ভাঙা রাস্তার গর্তে জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ময়লা-আবর্জনা সিটি কর্পোরেশন সরিয়ে নিচ্ছে না। মানুষও ময়লা ফেলা বন্ধ করছে না। ফলে দিন দিন বড় হচ্ছে স্তূপ। এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও তৈরি হচ্ছে।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে ও নিচে, ভাঙা রাস্তার গর্তে এবং বাসাবাড়িতে থাকা বিভিন্ন গাছের টবে জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় প্রতি ঘরে কেউ না কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে যাদের অবস্থা খারাপ তারাই হাসপাতালে যাচ্ছেন। বাকিরা বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দিন দিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। 

আরও পড়ুন : শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

রাজধানীর শাহজাদপুরের বাসিন্দা মো. ইয়াকুব ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২০ দিন ধরে মশার উৎপাত অনেক বেশি। আমার স্ত্রী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এক সপ্তাহ ভুগে এখন সুস্থ হয়েছেন। দিন-রাত মশায় কামড়ায়। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানো হলেও মশা কমছে না। কীভাবে কমবে, যেসব জায়গায় মশার প্রজনন হচ্ছে সেগুলো তো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। রাস্তার পাশে ময়লা-আবর্জনা, সেখানে জমছে পানি। আবার নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে যত্রতত্র পানি জমে থাকতে দেখা যায়। এসব পরিষ্কার করা না হলে তো ওষুধ ছিটিয়ে লাভ হবে না।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

রাজধানীর কালাচাঁদপুরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, বাসাবাড়ির টব থেকে পানি সরিয়েও মশার কামড় থেকে বাঁচা যাচ্ছে না। এখন তো করোনার চেয়ে ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। আতঙ্কে আছি। রাস্তায় বের হলেই দেখি যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। কেউ এগুলো পরিষ্কার করছে না। মানুষও সচেতন হচ্ছে না। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলছে। সামান্য পানি জমে জন্ম হচ্ছে এডিস মশার। শুধু ফগার মেশিনে ওষুধ না ছিটিয়ে সিটি কর্পোরেশনের উচিত এসব ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা। যারা যত্রতত্র এগুলো ফেলছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারা বছরের তুলনায় বর্ষা মৌসুমে মানুষ সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। এ সময় নানা স্থানে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশা জন্মানোর পরিবেশ তৈরি হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মানুষের অসচেতনতা ঢাকাসহ সর্বত্র ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু : নাগরিক ও দায়িত্বশীলদের দায় 

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি ব্লকে ভাগ করে ১০টি টিম গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পুরস্কারের ব্যবস্থা করে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। স্বল্প সময়ের অভিযান বা কার্যক্রম পরিচালনা করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এটি নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে পাঁচ থেকে ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা। তাই সিটি কর্পোরেশন ও নগরবাসী একে-অপরকে দোষারোপ না করে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

এদিকে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দিন-রাত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) কাউন্সিলররা কাজ করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এজন্য ডিএনসিসির স্টাফদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

দিন দিন বড় হচ্ছে ময়লার স্তূপ/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে ডিএনসিসির ১৮নং ওয়ার্ডের (বারিধারা, কালাচাঁদপুর, নর্দা ও শাহজাদপুর) কাউন্সিলর মো. জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমার এলাকায় চিরুনি অভিযান চলছে। আমার ২৫ জন স্টাফ রয়েছেন। সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যা যা করণীয়, তা-ই করা হচ্ছে। সকালে লিকুইড ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, বিকেলে মেশিনের মাধ্যমে ফগিং করা হচ্ছে।

ডেঙ্গুর সর্বশেষ পরিস্থিতি

গতকাল ৭ অক্টোবর সারাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ জনে।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে করণীয় কী?  

গত এক দিনে দেশে ২৪০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সবমিলিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৮২ জনে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়াদের মধ্যে ১৯২ জন ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৮ জন। সবমিলিয়ে বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ৭২৫ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছেন ৫৫৭ জন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ হাজার ৫২৩ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৭ হাজার ১৭৭ জন।

গত ৬ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এটি চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।

এমএসি/এসএসএইচ/