ফেসবুক ইনবক্সে একজন গণমাধ্যমকর্মী আমাকে একটি নিউজ শেয়ার করেছেন। নিউজটিতে যে ছবি ছাপা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে তার স্ত্রী বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছেন ভর্তি করানোর জন্য। ঢাকার নন্দীপাড়ার বাসিন্দা পোশাকশ্রমিক আব্দুল মমিনকে নিয়ে তার স্ত্রী মুগদা জেনারেল হাসপাতালে আসেন ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে।

সেখান থেকে তাকে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর মমিনের স্ত্রী তাকে নিয়ে যান রেলওয়ে হাসপাতালে, কিন্তু রেলওয়ে হাসপাতাল থেকে জানানো হয় রেলওয়ে কর্মী ছাড়া সেখানে বাইরের কোনো রোগী ভর্তি করা হয় না। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে যান আব্দুল মমিন।

গাবতলীর বাসিন্দা হুমায়ূন আহমেদ জ্বর নিয়ে মিরপুর লালকুঠি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসকল হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে বিস্তর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ৫টি হাসপাতালে মধ্যে চারটি ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। রোগীদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে ডেঙ্গু মশা নিয়ে গবেষণা করা একজন মানুষ হিসেবে দারুণভাবে মর্মাহত হচ্ছি।

ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষ কয়েকটি হাসপাতালকে নির্ধারণ করে দেওয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে তবে সেটি করার আগে ওই হাসপাতালগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স এবং ডেঙ্গু পরীক্ষার যন্ত্রপাতির অবস্থা বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।

করোনা মহামারির মধ্যেই আরেকটি স্বাস্থ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে গড়ে আড়াইশ মানুষ। আগস্ট মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ২৩ আগস্ট ঢাকার ৫টি হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, কমলাপুরের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতাল, মিরপুর মাজার রোডের লালকুঠি হাসপাতাল ও কামরাঙ্গীচরের ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালকে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে নির্ধারণ করে দেয় সরকার।

মিরপুর লালকুঠি হাসপাতালের পরিচালক ডা. শামসুল করিমের ভাষ্যমতে, তার হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। সেখানে নেই কোনো মেডিসিন বা প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ। রেডিওলজিস্ট টেকনোলজিস্ট এবং নার্সের ও সংকট রয়েছে, নেই ডেঙ্গু টেস্ট করার সরঞ্জামাদি। (২৯ আগস্ট ২০২১, প্রথম আলো)

আরেকটি হাসপাতাল যেটি কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতাল নামে পরিচিত সেখানে সাধারণত চিকিৎসা দেওয়া হয় রেলওয়ে কর্মচারীদের এবং এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়। সে কারণে এখানে চিকিৎসার বিষয়টিও এখনো নিশ্চিত হয়নি বাহিরের ডেঙ্গু রোগীদের জন্যে।

আমিন বাজার ২০ শয্যা হসপিটাল এবং কামরাঙ্গীচরের ৩১ শয্যা হাসপাতাল দুটির অবস্থা খুবই নাজুক। আমিনবাজার হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখা ছাড়া অন্য কোনো কার্যক্রম নেই আর কামরাঙ্গীরচর হাসপাতালে নিজস্ব জনবল নিয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসা কোনোরকম শুরু হয়েছে।

যেসব এলাকা ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে (যেমন যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, ধোলাইপাড়, রসুলপুর, জুরাইন ইত্যাদি) সেসব এলাকার কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট চালু করা জরুরি।

ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষ কয়েকটি হাসপাতালকে নির্ধারণ করে দেওয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে তবে সেটি করার আগে ওই হাসপাতালগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স এবং ডেঙ্গু পরীক্ষার যন্ত্রপাতির অবস্থা বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।

হাসপাতাল প্রস্তুতে ধীরগতি থাকার কারণে বেসরকারি হাসপাতালে অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগী এবং তার স্বজনদের। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ভোগান্তির পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু রোগীদের ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়বে।

যেসব এলাকা ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে (যেমন যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, ধোলাইপাড়, রসুলপুর, জুরাইন ইত্যাদি) সেসব এলাকার কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট চালু করা জরুরি। এসব এলাকার মানুষের জন্য সবচাইতে কাছের হাসপাতাল মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং মিটফোর্ড হাসপাতাল।

মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতার তুলনায় ভর্তি আছে অনেকগুণ। আর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত থাকায় সেখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালে একটি ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু করা যায় কি না সে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। ডেঙ্গু হটস্পট এলাকার ক্রমবর্ধমান রোগীদের ভোগান্তি লাঘবে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

আমরা সকলেই জানি সরকারিভাবে অল্প সময়ের মধ্যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স প্যাথলজিস্ট এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা দুষ্কর। তাই আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এসব হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব না হলে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিটি বড় সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড চালু করে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com