ফ্লোরে কিংবা বেডে রোগীর জন্য জায়গা পেতে তাদের ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ২৪ রোগী স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। রোগীর চাপ বাড়ায় হাসপাতালে বেড সংকট দেখা দিয়েছে। যার সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ওয়ার্ড বয়রা। ফ্লোরে কিংবা বেডে রোগীর জন্য জায়গা পেতে তাদের ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ওয়ার্ডের পাশেই ওয়াশরুমে নোংরা পরিবেশে ফেলে রাখা হয়েছে রোগীদের বিছানার চাদর, ব্যবহৃত স্যালাইন পাইপ। রয়েছে ডাস্টবিনভর্তি ময়লা। সেখানে ভন ভন করছে মশা ও মাছি। ওয়াশরুম ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হওয়ায় বেসিন ব্যবহার করতে পারছেন না রোগীরা।

সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ২নং বিল্ডিংয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম তলার মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। তাদের জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নির্ধারিত রাখা হয়নি। অন্য রোগীদের সঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে তাদের। সরেজমিনে আরও দেখা যায়, অনেক ডেঙ্গু রোগী মশারি ব্যবহার করছেন না। মশারি দেওয়া হয়নি সবাইকে। কিছু রোগীর মশারি থাকলেও কেউ কেউ তা ব্যবহার করছেন না।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন? 

রোগীরা বলছেন, বেডের কিছু রোগী মশারি পেয়েছেন। কিন্তু গরম এত বেশি যে মশারি টানালে তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। তাই ইচ্ছা থাকলেও মশারি টানাচ্ছেন না। অন্যদিকে, যেসব রোগী ফ্লোরে বিছানা করে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের কেউ মশারি পাননি। তারা বলছেন, ‘মশারি চাইনি, হাসপাতাল থেকেও মশারি দেওয়া হয়নি।’

রোগীর চাপ বাড়ায় হাসপাতালে বেড সংকট দেখা দিয়েছে/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

ভর্তি হওয়া রোগীদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, অধিকাংশ রোগীই রাজধানীর কেরানীগঞ্জ, জুরাইন ও যাত্রাবাড়ী এলাকার।

কেরানীগঞ্জের জিয়ানগর থেকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে আসা জহির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাঁচদিন ধরে ভর্তি আছি। প্রথমে ফ্লোরে ছিলাম। এখন টাকা দিয়ে বেড পেয়েছি। ফ্লোর ও সিট বেড পাওয়ার জন্য দুবারে ৪০০ টাকা নিয়েছেন ওয়ার্ড বয়।

আরও পড়ুন : শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টসকর্মী খোকন মিয়া জানান, বেডের জন্য তার কাছ থেকে ৩০০ টাকা নিয়েছেন এক ওয়ার্ড বয়। তবে, তিনি ওই ওয়ার্ড বয়ের নাম প্রকাশ করেননি।

টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেন যাত্রাবাড়ীর কাজলা থেকে আসা শাহীনও। তিনি বলেন, মশারি চেয়েছি কিন্তু দেয়নি। বেড দেওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে দুবারে ৫০০ টাকা নিয়েছে। এভাবে ওয়ার্ড বয়রা সব রোগী থেকে ফ্লোরে বিছানা ও বেড দেওয়ার নামে টাকা নিচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেরানীগঞ্জের কদমতলী থেকে আসা এক রোগীর স্বজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেড পাইনি তাই ফ্লোরে বিছানা করেছি। হাসপাতাল থেকে আমাদের মশারি দেয়নি। বালিশ, চাদর, ট্রলি চেয়েছি। তারা বলেছে নেই। কিন্তু টাকা দিলে মুহূর্তেই সব মেলে। পরে বাসা থেকে বালিশ-চাদর আনিয়েছি।

ওয়ার্ডের পাশেই ওয়াশরুমে নোংরা পরিবেশে ডাস্টবিনভর্তি ময়লা/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

রোগীরা জানান, হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। চিকিৎসকরা নিয়মিত আসছেন। ভালো চিকিৎসা দিচ্ছেন। রোগীদের সুস্থ করতে তাদের চেষ্টার কমতি নেই।

সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে মোট এক হাজার ১১৫ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন মাত্র দুজন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৬৫ রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৩৫ জন। ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৫ জন। গত সপ্তাহে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির গড় ছিল ২০ জন। এ সপ্তাহে তা বেড়ে হয়েছে ৩৫ জন।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু : নাগরিক ও দায়িত্বশীলদের দায় 

রোগীদের মশারি না দেওয়ার বিষয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্টার ডা. মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত মশারি আছে। গরম ও বিদ্যুতের সমস্যার কারণে অনেক রোগী মশারি টানান না। আর ফ্লোরে যেসব রোগী আছেন তাদের মশারি টানানোর জন্য স্ট্যান্ড নেই। যাদের মশারি নেই হয়তো তারা চান না, তাই মশারি নেন না।

ভর্তি হওয়া অধিকাংশ রোগীই রাজধানীর কেরানীগঞ্জ, জুরাইন ও যাত্রাবাড়ী এলাকার/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

ওয়ার্ড বয়রা টাকার বিনিময়ে বিছানা দেন— এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা রোগীদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি হাসপাতালের রিসিট ছাড়া কাউকে কোনো টাকা না দিতে। যদি কেউ টাকা চান সেই তথ্য আমাদের জানাতে। কিন্তু রোগীরা জানান না। তারা কাউকে টাকা দিলেও স্বীকার করেন না। এখন পর্যন্ত কোনো রোগী টাকা দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেননি।’ 

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে করণীয় কী?  

তার মতে, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। তাই আগে সিট পেতে রোগীরা ওয়ার্ড বয়দের টাকা দিতে পারেন।

ওয়াশরুমে ডাস্টবিনভর্তি ময়লা ও ব্যবহৃত চিকিৎসাসামগ্রী ফেলে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, কাজের চাপ বেশি। এ কারণে হয়তো পরিষ্কার করতে দেরি হচ্ছে। তবে, পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আইবি/এসএসএইচ