# কর্মকর্তাদের আল্টিমেটামে পিছু হটলো ইসি
# পদোন্নতিযোগ্য প্রায় ২০০ কর্মকর্তা ইসিতে  
# নির্বাচনী বছরে ক্ষোভ বাড়ছে ইসি কর্মকর্তাদের
# দাবি আদায় না হলে আন্দোলনের হুমকি ইসি কর্মকর্তাদের
# প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে ইসি কর্মকর্তাদের

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের হাতে তিল তিল করে গড়ে ওঠা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নির্বাচন কমিশনের কাছেই রাখার দাবি দীর্ঘদিনের। কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরও তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই একতরফাভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে এনআইডি স্থানান্তর করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে নিতে আইন সংশোধনের কাজেও অনেক দূর এগিয়ে গেছে সরকার। বর্তমানে এনআইডি নিজেদের কাছে রাখাসহ আরও তিনটি দাবি যুক্ত করেছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা। তারা মোট চারটি দাবির প্রস্তাব দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্যান্য কমিশনারদের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসি কর্মকর্তাদের দেওয়া আল্টিমেটামে পিছু হটে একমাস সময় চেয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন।

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইডি স্থানান্তরের বিরুদ্ধে চলমান দাবির সঙ্গে নতুন করে আরও তিনটি দাবি যুক্ত করেছি। আমাদের পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও বাইরে থেকে প্রেষণে এডমিন ক্যাডারের জনবল আনার উদ্যোগ নিতে চাইছে কমিশন। বর্তমানে আমাদের প্রায় ২০০ জন পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন। অথচ আমাদের পদোন্নতি না দিয়ে তারা বাইরে থেকে লোক আনতে চাইছেন, যেটা আইনবিরোধী। এই দাবিগুলোর কারণেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের।

ইসি কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নতুন সচিব জাহাংগীর আলম ইসিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই কিছু কিছু বিষয় নিয়ে নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান সচিব চাচ্ছেন এডমিন ক্যাডার থেকে প্রেষণে কিছু কর্মকর্তা আনতে। আর প্রেষণে এইসব কর্মকর্তা আসলে নির্বাচন কমিশনের মূল সেক্টরগুলো তারা নিয়ন্ত্রণে নেবেন। কমিশনের পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও তাদের পদোন্নতি না দিয়ে বাইরে থেকে এডমিন ক্যাডারের কর্মকর্তা আনতে চাওয়া হচ্ছে। এর বাইরেও সচিব তার কথাবার্তায় ইসি কর্মকর্তাদের অযোগ্য বলে ইঙ্গিত দেন। এইসব সমস্যার ফলে এনআইডি স্থানান্তরের সঙ্গে বর্তমানে আরও চারটি দাবি যুক্ত হয়েছে। সরকার ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা নির্বাচনের বিষয়ে যা খুশি তা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এজন্য সমস্যা সমাধানে আন্দোলন করা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।

ইসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশন ও সচিব বিষয়গুলো যত সহজভাবে দেখে বাস্তবে অতো সহজ না। তারা চাইলেই এনআইডি নিয়ে যেতে পারে কিন্তু এটা নিলে কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সেটাও চিন্তা করতে হবে। ২০০৬ সালে একবার তারা এনআইডি নিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র তিনমাস পরেই সেটা আবার ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের মন চাইছে তারা প্রেষণে লোক নিচ্ছেন। অথচ আমাদের পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছেন না। আবার উনারা বলছেন, আমাদের নাকি যোগ্যতা নেই। আমাদের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের যোগ্যতা না থাকলে এত অল্প জনবল দিয়ে ১২ কোটি ভোটারকে এনআইডি সেবা দিতে পারতেন না। আমাদের স্যাররা গায়ের জোরে অনেক কিছুই বলছেন। এখন বাস্তবতা মেনে সবকিছু বুঝে কাজ করতে হবে।  

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গত ২৯ নভেম্বর আমরা বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে চার দফা দাবিযুক্ত একটি প্রস্তাব ইসি সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের দিয়েছি। আমরা প্রস্তাবে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ৫ ডিসেম্বর কালোব্যাজ ধারণ এবং ৮ ডিসেম্বর অর্ধদিবস কলম বিরতি পালনের কথা উল্লেখ করি। আমাদের দাবিগুলো নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর প্রায় দুই ঘণ্টা সিইসিসহ চার কমিশনার বৈঠক করেন। পরে ১ ডিসেম্বর আমাদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে সিইসি সাক্ষাৎ করতে বলেন। ১ ডিসেম্বর সিইসির সঙ্গে আলাপে তিনি আমাদের কাছে এক মাস অর্থাৎ চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চান। সিইসির আশ্বাসে আমরা আপাতত আমাদের কর্মসূচি চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করি। প্রশাসনের কর্মকর্তারা নানা জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের বছর সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সম্পর্ক খারাপ করতে চাইছেন। ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হলে আন্দোলনের মাত্রা আরও কঠিন হবে বলে জানান তিনি।  

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের দাবিগুলো হলো—এনআইডি সেবা কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখা, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সব ধরনের প্রেষণে পদায়ন বন্ধ করা ও শূন্য পদ পূরণে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ইভিএম প্রকল্প লজিস্টিকসহ (ওয়্যারহাউজ ও যানবাহন) অনুমোদনে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, প্রস্তাবিত সাংগঠনিক কাঠামো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

নির্বাচন কমিশন (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮ সংশোধনে বলা আছে, অতিরিক্ত সচিব থেকে প্রায় সব পদেই ইসি কর্মকর্তাদের থেকে পদোন্নতি দিতে পারে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। শুধুমাত্র আইন শাখার যুগ্ম-সচিব ও উপ-সচিবের পদটি প্রেষণে বদলির মাধ্যমে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণ করতে হবে। পাশাপাশি উপ-প্রধানের পদটিও প্রেষণে বদলির মাধ্যমে বিসিএস (ইকনমিক) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণ করতে হবে। এছাড়া, বাকি সবগুলো পদ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা না পেলে এই পদে প্রেষণে বদলির মাধ্যমে পূরণ করতে পারবে ইসি। কিন্তু পদোন্নতিযোগ্য বিশাল জনগোষ্ঠী ইসিতে থাকলেও তাদের দিনের পর দিন পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

ইসির বিশ্বস্ত একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানায়, বর্তমানে পদোন্নতি পাওয়ার মতো প্রায় ২০০ জন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন অপেক্ষমান আছেন। যুগ্ম-সচিব, উপ-সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবসহ প্রায় সব পদেই পদোন্নতি পাওয়ার মতো কর্মকর্তা আছেন। নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করলেই কমিশনের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে পারে। পদোন্নতি দিলে সরকারের আর্থিক চাপ তেমন বাড়বে না।

বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চাচ্ছি আমাদের মধ্যে যারা পদোন্নতির যোগ্য তাদের মধ্য থেকে আগে পদোন্নতি দেওয়া হোক। আমাদের মধ্য থেকে পদোন্নতি দিয়ে যদি কোনো পদ থাকে তাহলে প্রেষণে কর্মকর্তা আনলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। আমরা এই যৌক্তিক দাবিটিই কমিশনের কাছে তুলে ধরেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে হাসানুজ্জামান বলেন, সচিব স্যার নতুন এসেছেন, আমাদের সঙ্গে কাজ করলেই তো উনি বুঝতে পারবেন আমরা যোগ্য নাকি অযোগ্য। আমরা যোগ্য কিনা সেটা আমাদের সঙ্গে কাজ না করে এ ধরনের মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আগে আমাদের সঙ্গে কাজ করে তারপর উনি মন্তব্য করলে ভালো হবে।

এর আগে, গত ২৯ নভেম্বর ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের পদ শূন্য থাকার পাশাপাশি যোগ্যতাও থাকতে হবে। প্রথমত হচ্ছে, পদ শুন্য থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, যোগ্যতা থাকতে হবে। এই দুটি বিষয় বিবেচনা করে আমরা অবশ্যই কমিশনের মাধ্যমে তাদেরকে তাদের পদোন্নতি বা শূন্য পদ পূরণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করব।

সিইসির নেওয়া সময়ে যদি আপনাদের দাবিগুলো পূরণ না হয়, সেক্ষেত্রে আপনারা কি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সিইসি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরা সিইসির প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রাখতে চাই। আর যদি এই সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো কিছু না হয়, তাহলে আবার আমরা সংগঠনের মিটিং ডেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো কমিশনের কাছে তুলে ধরেছি। কমিশন আমাদের বিষয়গুলো খণ্ডন করে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমরা রাষ্ট্র বা কারো বিরুদ্ধে অথবা ব্যক্তি স্বার্থে কিছুই করছি না। আমরা শুধুমাত্র সমস্যাগুলো তুলে ধরেছি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের উত্তাপ-উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বের ফলে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের প্রতিফলন ফুটে উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে জনস্বার্থের পরিবর্তে ভোটারি স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে, বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটির মূল যেই ম্যান্ডেট, সেটা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনকে জনস্বার্থের পরিবর্তে ভোটারি স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। এইসব ভোটারি স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। অতীতে যখন ভোটারি স্বার্থে কমিশনকে ব্যবহার করা হলেও কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। এখন কর্মকর্তাদের স্বার্থহানি হচ্ছে বিধায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা প্রতিবাদ করছেন। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনকে পরিচ্ছন্ন করা দরকার। যাতে করে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যার ম্যান্ডেড থাকবে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা।

পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা থাকলেও প্রেষণে জনবল আনা নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় ব্যাঘাত ঘটাবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে সুজন সম্পাদক বলেন, অবশ্যই এটা হলে নির্বাচন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটবে। এতে করে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যাবে এবং এই প্রতিষ্ঠানটির আইন, বিধিমালার ব্যত্যয় হবে। তাছাড়া, এটা তো অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে বহু আগেই নির্বাচন কমিশন একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করার অপচেষ্টা বন্ধ হয়নি। যারা অতীতে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ভোটারি স্বার্থে ব্যবহারের সায় দিয়েছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের দূরত্ব তৈরি হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। এটা কার্যকর প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরিপন্থি হবে এবং এটার দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হবে, প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে যেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের দূরত্ব কমিয়ে আনা হয়।  

এ বিষয়ে জানতে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানাকে একাধিক ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এসআর/কেএ