গোডাউন মালিক, কাভার্ডভ্যান, ট্রাক বা গার্মেন্টস পণ্য বহনকারী যানবাহনের চালক ও হেলপারের যোগসাজশে গার্মেন্টস শিল্পের পণ্য চুরি হচ্ছে। কয়েকটি অভিযানের পর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানা এলাকা হতে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের গার্মেন্টস পণ্য জব্দ করে র‌্যাব-৪ এর একটি দল। এ ঘটনায় জড়িত সংঘবদ্ধ আন্তঃজেলা চোর চক্রের মূলহোতাসহ সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

র‌্যাব জানিয়েছে, গার্মেন্টস পণ্য চুরির ব্যাপারে একটি ধারণা পায় র‌্যাব। এক বা একাধিক মাস্টারমাইন্ড রয়েছে যারা গার্মেন্টসের পণ্যবাহী পরিবহনের ড্রাইভার ও হেলপারদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। পরে গার্মেন্টস পণ্য নির্বিঘ্নে চুরি করে।

শনিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে র‌্যাব-৪ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এসময় এ তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রহমান।

তিনি বলেন, গত ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়া হচ্ছিল। পথিমধ্যে কাভার্ড ভ্যান থামিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করার সময় নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার ভাইভাই টিম্বার স’মিলের গোডাউনে অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব-৪।

সেখান থেকে ৫ কোটি টাকা মূল্যের চোরাইকৃত প্রায় ২৬ হাজার ৯৯৫ পিস গার্মেন্টস পণ্যসহ একটি কাভার্ড ভ্যান জব্দ করা হয়। এসময় সংঘবদ্ধ চক্রটির মূলহোতাসহ সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তাররা হলেন—রিপন ওরফে ছোট রিপন (৪৩), বিল্লাল হোসেন ওরফে ছোট বিল্লাল (৩৬), নাঈম ইসলাম (২৭), মো, আকাশ (২৬), মো. সুমন (৩০), মো. ফরিদ (৩৮) ও মঞ্জুর হোসেন জিকু (৩৮)।

লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, টাকার লোভে চালক ও হেলপারেরা গার্মেন্টস পণ্য গোপনে সরিয়ে ফেলতে চোর চক্রের প্রস্তাবে রাজি হয় ও সহায়তা করে। বন্দরে প্রদর্শনের জন্য গার্মেন্টেসের পক্ষ থেকে পণ্যের স্যাম্পল চালকের কাছে দেওয়া হয়ে থাকে। এ স্যাম্পল পাওয়ার পরপরই চালক সুযোগ বুঝে ছবি তুলে মূলহোতার কাছে পাঠায়। পণ্যের বাজার মূল্যের বিবেচনায় অধিক লাভজনক হলে মূলহোতা চালক ও হেলপারের সঙ্গে পরবর্তী চুক্তিতে যায়।

মূলহোতা আগে থেকেই অসাধু গোডাউন মালিকের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করে থাকে। এরপর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী নির্জন জায়গা থেকে ড্রাইভার ও হেলপারের মাধ্যমে পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যানটি সেই গোডাউনে নিয়ে যায়।

গোডাউনে কাভার্ড ভ্যান প্রবেশের আগেই কার্টন প্যাকেজিং ও লোড-আনলোডের কাজে কয়েকজন সহযোগী সেখানে অবস্থান করে। তারা দেড়-দুই ঘণ্টার মধ্যে কার্টনের মালামাল সরিয়ে ফেলে। এরপর ৩০ থেকে-৪০ শতাংশ মালামাল রেখে প্রত্যেক কার্টনে সমপরিমাণ ঝুট কাপড় রেখে সঠিকভাবে প্যাকেজিং করে কাভার্ড ভ্যানে লোড করে দেয়।

র‌্যাব-৪ অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গত ২৬ জানুয়ারি বিকেল নাগাদ ফ্যাক্টরি থেকে পণ্য কাভার্ড ভ্যানে লোড করে তেজগাঁও এ যায়। পরে কাভার্ড ভ্যানে জ্বালানি তেল ভরে পাম্পে গাইডের জন্য কিছুক্ষণ অবস্থান করে। গাইড নাঈম এসে মূলহোতা রিপনের নির্দেশ অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার লাঙ্গলবন্দস্থ ভাইভাই টিম্বার স’মিলের উদ্দেশে রওনা করে।

সেখানে পৌঁছানোর পরে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল বিল্লাল হোসেন, ফরিদ ও মঞ্জুরসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজন। তারা বিশেষ কৌশলে কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে কাভার্ড ভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বল্টু গ্যানিং মেশিনের মাধ্যমে কেটে প্রত্যেক কার্টন গোডাউনের ভেতর নামায়।

কার্টন থেকে মালামাল চুরির সময় র‌্যাব-৪ এর দল ২৭ জানুয়ারি ভোরে কাভার্ড ভ্যানটির ড্রাইভার, হেল্পার, ‘স’ মিল মালিক, লেবার সর্দারসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে।

এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড রিপন ও বিল্লাল কিছু সময়ের মধ্যে চোরাই করা গার্মেন্টস পণ্যগুলো বুঝে নিতে আসলে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

কার চালক থেকে চক্রের হোতা রিপন

গ্রেপ্তার রিপন ওরফে ছোট রিপন এই চক্রের মূলহোতা। সে প্রথম জীবনে ১৯৯০ সালে ঢাকায় এসে সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। সে ২০০৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে যায়। ২০১৭ সালে দেশে ফিরে এসে রেন্ট এ কার চালক হিসেবে কাজ করাকালে গামেন্টর্স পণ্য চোর চক্রের হোতাদের সাথে পরিচয় হয় এবং তাদের সহযোগী হিসেব কাজ শুরু করে।

পরবর্তীতে অধিক পরিমাণ লাভের আশায় গ্রেপ্তার রিপন নিজেই অপরাপর আসামী বিল্লাল হোসেন, নাঈম ইসলাম, আকাশ, সুমন, ফরিদ, মঞ্জুর হোসেন জিকুসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জনকে নিয়ে একটি সক্রিয় আন্তঃজেলা চোর চক্র তৈরি করে।

মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে চক্রে জড়ায় বিল্লাল

গ্রেপ্তার বিল্লাল মূলহোতা রিপনের প্রধান সহযোগী। মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে ঢাকা জজ কোর্ট এলাকায় চোরচক্রের মূলহোতা রিপনের সঙ্গে বিল্লালের পরিচয় হয়। আসামি বিল্লালের গ্রামের বাড়ি মুন্সিঞ্জের গজারিয়া এলাকায়। এই চুরির ঘটনাগুলো যেহেতু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সংঘঠিত হয়ে থাকে তাই মূলহোতা রিপন আসামি বিল্লালকে গোডাউন ভাড়া করার কাজের প্রস্তাব দেয়। তখন থেকেই বিল্লাল গোডাউন ভাড়া করার বিষয়টি দেখে আসছে।

মূলহোতা রিপন গার্মেন্টস পণ্য চুরির জন্য যখন কোনো কাভার্ড ভ্যান নির্ধারণ করে নাঈমকে অবগত করে। নাঈম কাভার্ড ভ্যানটি ঢাকা থেকে পূর্ব নির্ধারিত গোডাউনে পৌঁছানো এবং গার্মেন্টস পণ্য চুরির সময় গোডাউনের আশেপাশে নজরদারিসহ সার্বিক দায়িত্বে থাকত।

গ্রেপ্তার ফরিদ প্যাকেজিং করার কাজে অত্যন্ত দক্ষ হওয়ায় সে কার্টন থেকে মালামাল বের করে আবার প্যাকেজিং করতো।

গ্রেপ্তার মঞ্জুর গোডাউনের মালিক এবং ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি। তার কাছে থাকা গ্যানিং মিশিন দিয়ে কাভার্ড ভ্যানের নাট-বল্টু কাটার কাজ করে। ড্রাইভার আকাশ ও হেলপার সুমন মূলহোতা রিপনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তার কথামতো নির্ধারিত গোডাউনে গাড়ি পার্ক করত। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির একাধিক মামলা রয়েছে।

র‌্যাব-৪ সিও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়।দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক রাপ্তানি খাত থেকে। বিগত কয়েক বছর ধরে কয়েকটি চক্র বেপরোয়াভাবে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে তা চোরাইপথে বিক্রি করছে। 

এই চুরির বিষয়টি জানা যায়, গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির শেষ ধাপে; যখন বায়ার বা ক্রেতা তার দেশে পণ্য গ্রহণ করে। এতে করে সেসসব ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য না পেয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে। এছাড়া খোয়া যাওয়া পণ্যের দামের দ্বিগুণ, তিনগুন জরিমানা করে থাকে। তাছাড়া ক্রয়াদেশ বাতিলসহ তাদের পরিচিত বায়ারদেরকেও বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে নিরুৎসাহিত করে।

চুরির ঘটনা রোধে ২০২১ এর মাঝামাঝি সময়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এর একটি যৌথ প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট গার্মেন্টস পণ্য চুরি রোধে কার্যক্রম শুরু করে।

র‌্যাব-৪ ২০২১ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজীপুর, আশুলিয়া, মিরপুর, আমিনবাজার, কুমিল্লা, নারায়নগঞ্জ ও ডেমরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চক্রের মূলহোতাসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। এসব অভিযানে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের গার্মেন্টস পণ্য উদ্ধার করা হয়েছে।

জেইউ/কেএ