বইমেলায় দর্শনার্থীরা/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

করোনাভাইরাসের কারণে এবারের বইমেলা ১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে শুরু হয় ১৮ মার্চ। তবে দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ায় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে এ মেলা- এমনই আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘মেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’ বলে গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে মেলা প্রাঙ্গণে। গুঞ্জন থেকে সৃষ্ট আশঙ্কাকে আরও প্রকট করেছে করোনার লাগাম টেনে ধরতে সোমবার (২৯ মার্চ) সরকারের দেওয়া ১৮ নির্দেশনা। এর মধ্যে একটি নির্দেশনায় সবধরনের মেলা আয়োজনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এতে এবারের ‘বইমেলার পর্দা আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই নামতে পারে’- এ আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে।

বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকদের ধারণা, আগামী ২-৩ এপ্রিলের মধ্যে মেলা বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে যাচ্ছে। এদিকে, মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি বলছে, এখনও মেলা বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে মেলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বাংলা একাডেমি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর বাংলা একাডেমি এককভাবে বইমেলার আয়োজন করে। কিন্তু এবার করোনার কারণে এটির ব্যতিক্রম হয়েছে। এবারের মেলার আয়োজন করা হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি এবং প্রকাশকদের যৌথ সিদ্ধান্তে। ফলে মেলা বন্ধের সিদ্ধান্তও হবে এই তিন পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে। তাই আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে মেলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তিন পক্ষকে নিয়ে বৈঠক ডাকা হবে। সেখানে মেলার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তবে সরকার যেহেতু মেলা আয়োজনে নিরুৎসাহিত করেছে, তাই চাইলেও এবার মেলা ৩০ দিন পূর্ণ করা সম্ভব হবে না। এর আগেই মেলা বন্ধ করে দিতে হবে।

বইমেলায় তরুণ দর্শনার্থীরা

বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য জালাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এবারের মেলার সিদ্ধান্ত তো বাংলা একাডেমি এককভাবে নেয়নি। প্রকাশক সমিতির নেতৃত্ববৃন্দ, সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সবাই মিলে মেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে সবার সিদ্ধান্তক্রমেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি এবং সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত তো বাংলা একাডেমির। তারা যদি নির্দেশনা দেয় মেলা বন্ধ করে দেওয়ার তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। তবে সরকার যদি শপিংমল চালু রাখে, তাহলে বলব সেই তুলনায় বইমেলা অনেক নিরাপদ।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা একাডেমি এখনও কোনো বৈঠক ডাকেনি। তারা যদি কোনো বৈঠকে আমাদের ডাকে, তাহলে এর আগে আমাদের সমিতির মিটিং করে সেখানে যে মতামত আসবে সেটাই আমরা তুলে ধরব।’

তবে প্রকাশকদের আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতির এক নেতা বলেন, ‘আমরা এবার শুরু থেকে চেয়েছি, মেলাটি যেন ছোট পরিসরে হয়। মেলার মেয়াদও ১৫ দিন হোক। এতে মেলা না হওয়ার আক্ষেপও থাকবে না, অন্যদিকে প্রকাশকরাও করোনার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু সেটা না করে, বড় পরিসরে মেলার আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। এখন সরকার বলছে, মেলা বন্ধ করতে।’

মলিন বইমেলার শিশু চত্বর

তিনি আরও বলেন, ‘‘প্রতি বছর মেলার শেষে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ ও ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হতো। এর মধ্যে বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হতো। কিন্তু বাংলা একাডেমি এই বছর নতুন বই এখনও জমা নিচ্ছে না। ফলে মনে হচ্ছে, মেলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে।’’

মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে শোভা প্রকাশনীর প্রকাশক মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এবারের মেলায় আমাদের অবস্থা খারাপ। দুজনকে বেতন দিতেও আমাদের কষ্ট হয়ে যাবে, একদমই বিক্রি নেই। করোনার কারণে হয়তো মেলাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আজকে সর্বোচ্চ আক্রান্ত। আমাদের কাছে খবর এসেছে, মেলা কয়েকদিনের মধ্যে হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।’

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার নতুন করে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। সেখানে একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছে- পর্যটন/বিনোদনকেন্দ্র সিনেমা হল/থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সবধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করতে হবে।

হেফাজতের হরতালের প্রভাব বইমেলায়

মেলার সময় পরিবর্তন

আগামীকাল (মঙ্গলবার) মেলার ১৩তম দিন। এ দিন মেলার দ্বার খুলবে বিকেল ৩টায়। চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। তবে মেলায় আগত দর্শনার্থীরা সাড়ে ৭টার পর আর প্রবেশ করতে পারবেন না।  যা আগে রাত ৯টায় পর্যন্ত চলতো।’

হাজারের ওপরে নতুন বই মেলায়

সোমবার (২৯ মার্চ) পর্যন্ত বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা এক হাজার ৪৯১টি। ১২ দিনে হাজারের বেশি বই বের হলেও গুণগত বিবেচনায় সব বই টানে না পাঠককে। তবে ইতোমধ্যে মেলায় এসে গেছে বেশ মানসম্মত গ্রন্থ। সেগুলো হলো- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রচিত ‘বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের মুখোমুখি’ শিরোনামের প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। এখান থেকে বেরিয়েছে আহমদ রফিকের প্রবন্ধের বই ‘নবজাগরণের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব’, রামেন্দু মজুমদারের প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু ও বিবিধ ভাবনা’, হাসান আজিজুল হকের কাব্যগ্রন্থ ‘সুগন্ধি সমুদ্র পার হয়ে’ এবং ওয়াসি আহমেদের উপন্যাস ‘বরফকল’। আগামী থেকে প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আনিসুজ্জামান, হাসনাত আবদুল হাই, শামসুর রাহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সৈয়দ শামসুল হক ও বেলাল চৌধুরীর সিরিজ গ্রন্থ। এখানে মিলছে মঞ্জু সরকারের উপন্যাস ‘দাম্পত্য বিলাস’।

করোনার সবশেষ পরিস্থিতি

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ১৮১ জন। ফলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৮৯৫ জনে। এটিই দেশে করোনায় এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের ঘটনা। এর আগে গত বছরের ২ জুলাই দেশে করোনায় চার হাজার ১৯ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। এতদিন সেটিই ছিল একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা। 

এদিকে ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ৪৫ জন। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল আট হাজার ৯৪৯ জনে। গত বছরের ২৮ আগস্টের পর এটিই দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। 

সোমবার (২৯ মার্চ) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৭৭ জন। এ পর্যন্ত মোট করোনামুক্ত হয়েছেন পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ১৮ জন।

এএইচআর/ আরএইচটি/এফআর