করোনা মহামারি প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়েই ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে মার্চেই শুরু হয় এবারের অমর একুশে বইমেলা। তারপরও মহামারির চোখরাঙানিকে সঙ্গী করেই চলছিল প্রাণের মেলা। করোনার কারণে অন্যাবারের তুলনায় ক্রেতা-দর্শনার্থী কম হওয়ার শুরুতে কিছুটা মলিনতার ছাপ ছিল। তবে, ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছিল বইমেলার স্বরূপ। ছুটির দিনগুলোয় বাড়ছিল পাঠকের আনাগোনা। বসন্তের পরিবর্তে চৈত্রের খরতাপে মেলা হওয়ায় মূলত দুপুর গড়ানো বিকেলে থেকে গ্রন্থানুরাগীদের উচ্ছ্বাস আর জমাটবাঁধা আড্ডার মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। 

তবে বুধবার (৩১ মার্চ) সন্ধ্যা নামার আগেই ঘটলো ছন্দপতন। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর বন্ধ হয়ে যায় মেলার প্রবেশদ্বার। ফলে ঘর বা অফিস থেকে মেলায় এসে অনেকেই ফিরে গেছেন একরাশ হতাশা নিয়ে। কারণ, মেলার ১৪তম দিনে আকস্মিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়, এখন থেকে মেলা চলবে বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত।
নতুন নিয়মে প্রতিদিন সাড়ে ৩ ঘণ্টা হলেও শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত।

ক্রমবর্ধমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আয়োজক বাংলা একাডেমির এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে পাঠকরা। স্বাভাবিক কর্মদিবসে সাড়ে তিন ঘণ্টার মেলা হওয়ার চেয়ে বন্ধ করে দেওয়াকে শ্রেয় মনে করছেন প্রকাশকরা। তাদের যুক্তি, এবারের মেলা হচ্ছে ১৫ লাখ বর্গফুটের বিস্তৃত পরিসরে। যথেষ্ট ফাঁকা স্থান রেখেই বিন্যস্ত হয়েছে বইমেলা। এছাড়া মেলার প্রবেশপথে রয়েছে শরীরের তাপমাত্রা মাপাসহ স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা। পাশাপাশি স্টলের বিপণনকর্মী থেকে মেলায় আগত অধিকাংশ মানুষই মাস্ক পরিধানসহ মানছেন স্বাস্থ্যবিধি। সেই তুলনায় শপিংমল, রেস্তেরাঁ, বাজার বা গণপরিবহনে মানা হচ্ছে না সামাজি দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি। তাহলে মেলা নিয়ে এতো টালবাহানা? শপিং মহল তো ঠিকই রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা রেখেছে সরকার।

এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন প্রকাশকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন  জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। মেলা প্রাঙ্গণে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বইমেলা বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বাংলা একাডেমি। নীতিমালা লঙ্ঘন করে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বইমেলা পরিচালনা কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিদিন রাত নয়টা পর্যন্ত মেলা চলার কথা। কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রকাশক বা মেলার পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কোনো আলাপ করেনি।

তিনি আরও বলেন, লেখক, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা পেশার সম্পৃক্ত রয়েছে এ কমিটিতে। অথচ এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তারা কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। এর আগে শবে বরাতের দিন বলা হলো, এদিন লোকজন কম আসবে তাই মেলা রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। আমরা সেটা মেনে নিলাম। অথচ পরদিন থেকে দেখা গেলে স্থায়ীভাবে মেলার সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে নয়টার পরিবর্তে রাত আটটা করা হয়েছে। আর বুধবার এক লাফে আড়াই ঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হলো সময়সূচি। এমন মেলা হওয়ার চেয়ে না হওয়াই অনেক ভালো। এটাকে হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করছি আমরা।

অন্য প্রকাশনীর মালিক মাজহারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতবারের তুলনায় এবার মেলায় মাত্র দশ শতাংশ মানুষ আসছে। এ দশ শতাংশের মধ্যে আবার নব্বই শতাংশই আসেন সন্ধ্যাবেলায়। এখন পুরোপুরি সন্ধ্যা নামার আগেই মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকাশকরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  এমনিতেই জনসমাগম কম ঘটায় ঠিকমতো মেলা চললেও আমাদের  লোকসান হতো। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সেই লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে। এর ফলে মেলাকে ঘিরে মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর পথ রুদ্ধ হলো।

প্রকাশকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, আমরাও চেয়েছিলাম স্বাভাবিকভাবেই চলুক বইমেলা। কিন্তু পরিস্থিতির কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাছাড়া এটা শুধুমাত্র বাংলা একাডেমির একক সিদ্ধান্ত নয়। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। 
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তরুণ লেখক জামশেদ নাজিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বইমেলার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়টি হচ্ছে সন্ধ্যাবেলা। চৈত্র মাসের ভরদুপুরে করা রোদ মাথায় নিয়ে মানুষ মেলায় আসে না। তাই বিকেলে রওনা দিলেও যানজট পেরিয়ে মেলায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বিশেষ করে কর্মজীবীদের জন্য এটি সবচেয়ে ভালো সময়। অথচ সেই জমে ওঠা সাঁঝবেলাতেই মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার কাছে এ সিদ্ধান্তকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে।

বুধবার সন্ধ্যায় অফিস শেষে মেলায় প্রবেশদ্বারে এসে ঢুকতে পারেননি মনোজিৎ মিত্র। ক্ষোভের সঙ্গে এই দর্শনার্থী বলেন, কর্মজীবনের শুরু থেকে চিরকাল সন্ধ্যাবেলাতেই মেলায় এসেছি। বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ার পাশাপাশি পুরনো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় দিয়েছি। অথচ আজ কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মেলায় এসে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অন্তত দুই দিন আগে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে আর এ বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। 

আজকে নতুন বই 
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার নতুন বই এসেছে ৯৭টি। এর মধ্যে গল্প ১৪টি, উপন্যাস ১৬, প্রবন্ধ ৫, কবিতা ৪১, গবেষণা ১, ছড়া-১, জীবনী ৩, নাটক ৩, বিজ্ঞানবিষয়ক ২টি, ভ্রমণ ১, ইতিহাসবিষয়ক ১,  স্বাস্থ্য ১টি, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ৪টি,  অনুবাদ ২টিসহ  অন্যান্য বিষয়ের ২টি বই এসেছে। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আগামী থেকে এসেছে মঞ্জু সরকারের উপন্যাস ‘উজানযাত্রা’ এবং অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী সম্পাদিত ‘বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব স্মারকগ্রন্থ’। পালক পাবলিশার্স থেকে এসেছে রাজু আহমেদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘একান্ত আলাপে সৈয়দ আবুল মকসুদ’। জিনিয়াস পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে বুলবুল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কিশোর গল্পগাথা’, ধ্রুব এষের উপন্যাস ‘আমার একজন মানুষ’ এবং ফেরদৌস হাসানের উপন্যাস ‘কে জেগে আছো’।  অবসর থেকে বেরিয়েছে হায়াৎ মামুদের ‘কিশোর জীবনী নজরুল ইসলাম চিত্ররূপময় আলেখ্য’। গ্রন্থ কুটির থেকে এসেছে আয়েশা মুন্নির কাব্যগ্রন্থ আবছায়ার অন্তরালে’। 

এএইচআর/এসএম