আলোচনা সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অন্যান্য দেশের ভ্যাকসিনের পেছনে না ছুটে নিজ দেশেই তা তৈরির বিষয়ে নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

অনেকদিন ধরেই শুনছি, ভ্যাকসিন আসবে। কিন্তু ভ্যাকসিন আসলে কে কয়টা পাবেন, সেটা আপনারা দেখেছেন। কিন্তু সরকার যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এ কাজে সম্পৃক্ত করত, তাহলে অক্সফোর্ডের সহায়তায় আমরাই ব্যাপক আকারে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারতাম।

ডা. জাফরুল্লাহ

সোমবার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে শীতকালে করোনা প্রতিরোধ ও করণীয় এবং শীতবস্ত্র বিতরণে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করোনা ভ্যাকসিন আগামী ‘জানুয়ারির যেকোনো সময়’ বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকার ক্রয়চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার ক্রয়চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির অধীনে জানুয়ারি থেকে শুরু করে পরবর্তী ছয় মাসে ৫০ লাখ করে মোট তিন কোটি ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ। প্রত্যেক ব্যক্তির দুই ডোজ করে টিকা নিতে হবে। অর্থাৎ এই তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষকে দেওয়া যাবে।’ 

এদিকে ২১ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, আগামী মে থেকে জুনের মধ্যে দেশে সাড়ে চার কোটি মানুষের জন্য নোভেল করোনাভাইরাসের টিকা আসছে। জানুয়ারির শেষ কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে দেড় কোটি মানুষের জন্য তিন কোটি টিকা আসবে। পরে বাকি টিকা আসবে। দ্বিতীয় দফায় আরও তিন কোটি মানুষের জন্য টিকা আসবে। ২০ শতাংশ মানুষকে এ টিকা দেয়া যাবে। অর্থাৎ সাড়ে চার কোটি মানুষকে টিকা দেয়া যাবে। 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে কত মানুষকে এবং কতদিনের মধ্যে করোনা টিকার আওতায় আনা যাবে। 

রোগতত্ত্বের সূত্র অনুসারে, করোনা মহামারি থেকে কোনো দেশকে মুক্ত করতে মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশের মধ্যে অ্যান্টিবডি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রভাবে বাকি ২০ শতাংশ মানুষের দেহে আপনা থেকেই ইউমিউনিটি তৈরি হবে। এমন তত্ত্ব সামনে রেখে দেশে সাড়ে ১৭ কোটি মোট জনসংখ্যা ধরে ১৪ কোটি মানুষের দেহে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সাড়ে চার কোটি মানুষের টিকার জোগান নিশ্চিত হলেও বাকি প্রায় নয় কোটি মানুষের টিকার জোগান এখনও অনিশ্চিত!

ইতালিতে প্রথম করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হলো এক স্বাস্থ্যকর্মীকে / ছবি: সংগৃহীত

দেশেই করোনা ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা জানেন অক্সফোর্ডে পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু তারা কখনোই এটা প্যাটেন্ট করেনি। তারা মনে করেছিল যে, জনসাধারণের জন্য পেনিসিলিন উন্মুক্ত থাকবে। পেনিসিলিন যে পাত্রে আবিষ্কার করা হয়েছিল, তার একটি পাত্র তারা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে দান করেছিল। প্রতীকী অর্থে তারা বলতে চেয়েছিল যে, গণস্বাস্থ্যও যেন এসব কাজে সম্পৃক্ত থাকে। আমি নিশ্চিত ড. ইউনুস এবং অন্যান্য নোবেল লরিয়েটরা যদি অক্সফোর্ডকে বলত, তোমরা অতীতের মতো সহযোগিতা কর, আমরা আমাদের দেশেই করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করি। দেশীয় গ্লোবের করোনার ভ্যাকসিনও এগিয়ে রয়েছে। আমরাও ইচ্ছা করলে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারি। তাহলে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন তৈরি হতো। দেশের প্রতিটা লোক ভ্যাকসিন পেত।’

তিনি বলেন, আমরাই বিশ্বের প্রথম মার্চ মাসে অ্যান্টিবডি কিট আবিষ্কার করেছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে জড়িয়ে ধরে বলত, জাফরুল্লাহ জবর কাজ করেছ। কিন্তু সরকার প্রতিটা পদে পদে আমাদের কাঁটা বিছিয়েছে। এখনও আমরা অ্যান্টিবডি কিটের অনুমোদন পায়নি। এরপর অনেক দেশ অ্যান্টিবডি কিট উৎপাদন করেছে। আমাদের কিটের অনুমোদন দিলে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হতো। অ্যান্টিবডি কিট আবিষ্কার করতে আমাদের ১০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এই ১০ কোটি টাকা দিয়ে আমরা অনেক বেশি গরিব মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারতাম।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অ্যান্টিজেন কিট তৈরির প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল অ্যান্টিজেন কিট আবিষ্কার করল। সরকার আমাদের কন্ডিশন দিল যে, এ কিট আমেরিকা থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে হবে। এতে আরও তিন কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। আজ যদি এমন নিয়ম থাকত তাহলে বাংলাদেশে ওষুধ-নীতি হতো না। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ হতে পারত না।’

বক্তব্য দিচ্ছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

‘জাতির সামনে কঠিন বিপদ আসছে’ মন্তব্য করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আজ সাধারণ মানুষ যেমন পর্যুদস্ত, আমরা প্রত্যেকেই অবহেলিত এবং পর্যুদস্ত। যারাই তাদের কথা বলতে চাইবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে সরকার। সরকার উপলব্ধি করে না যে, সত্যটা কাছে আনলে সরকারের পরিকল্পনা অনেক সহজ হবে। সরকার তা না করে, যে সত্যটা তুলে ধরতে চাইছে, তার কণ্ঠরোধ করছে। এই কণ্ঠরোধ একদিন ওই রাজনীতিবিদকে কারাগারে নিয়ে যাবে। আমাদের জাতির সামনে কঠিন বিপদ আসছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সুবিবেচনা ও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা না করলে, জনসাধারণকে সম্পৃক্ত না করলে, এ সমস্যার সুরাহা হবে না।’

প্রবীণ এ চিকিৎসক বলেন, ‘সাংবাদিকরা করোনাকালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্ভীক, সচেতন সংবাদমাধ্যম ছাড়া কখনোই দারিদ্র্য নিরসন হবে না। সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে। একটা কথা আছে, মন যেটা জানে না, চোখ সেটা দেখে না। সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে।’

‘সাংবাদিক বন্ধুদের বলতে চাই, যতই আপনাদের বিপদ হোক, যে নির্ভীক ও সাহসিকতার সঙ্গে আপনারা কাজ করছেন, সেটা অব্যাহত রাখেন। সবাই মিলিতভাবে কাজ করলে দেশের দারিদ্র্যের হার অনেক কমবে। সবাই মিলে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। যতই বিপদ আসুক, মিলিতভাবে ন্যায় ও নীতির জন্য আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। এই সাহসই বাংলাদেশকে সুন্দর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। সামাজিক বৈষম্য না কমলে আমি, আপনি, কেউই সুখে থাকতে পারব না।’

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মঞ্জুর কাদির আহমেদ, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। সভা পরিচালনা করেন গণস্বাস্থ্যের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু।

টিআই/এমএআর