ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস করেও হারেননি। তবে করোনাভাইরাসের উপসর্গ ধরা পড়ার পরই তিনি হেরে গেলেন। প্রবীণ সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার যেন হঠাৎ করেই চলে গেলেন চিরঘুমে। বৃহত্তর সিলেটের সাংবাদিকতার ইতিহাস নিয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করছিলেন তিনি। তবে সেটি আর প্রকাশ করা হলো না।

নিজের অসুস্থতার বিষয়টি কাউকে জানতে দিতে চাইতেন না। সবসময় মুখে হাসি ফুটিয়ে অন্যদের হাসিতে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা ছিল তার। শেষ পর্যন্ত যাদের তিনি হাসি-খুশিতে ভরিয়ে রাখতে চাইতেন, তারা আজ তাদের প্রিয় হাসান শাহরিয়ারের জন্য কাঁদছেন।

উৎস প্রকাশন থেকে হাসান শাহরিয়ারের সব বই প্রকাশিত হয়েছে জানিয়ে প্রকাশক মোস্তফা সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাহরিয়ার ভাই চলেই গেলেন, এত তাড়া ছিল তার? তার মতো কে ভালোবেসেছিলেন আমাকে, আমি জানি না। এইতো সেদিনই কথা হলো, নতুন বইটা তুলে দিলাম তাকে।

গত বছরের আগস্টে বের হয় হাসান শাহরিয়ারের লেখা গ্রন্থ ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে তিনি উৎস প্রকাশনীর কার্যালয়ে যাননি। প্রকাশিত গ্রন্থটি সংগ্রহের জন্য তিনি সশরীরে উপস্থিত না হয়ে তার গাড়িচালককে পাঠিয়েছিলেন। উৎস প্রকাশনীর প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বলেন, হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে তারপরও আমার কথা হয়েছে। গত ১৫ দিন আগেও কথা হয়েছে। হঠাৎ করেই তিনি চলে গেলেন।

মোস্তফা সেলিম বলেন, প্রায় প্রতি বছর হাসান শাহরিয়ার ভাইয়ের জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হত রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে। অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। একবার তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম, পরবর্তী জন্মদিনের আগে তাকে নিয়ে সংবর্ধনা গ্রন্থ বা স্মারক গ্রন্থ বের করব। পরের বছর ২০১৮ সালে হাসান শাহরিয়ার ভাইয়ের জন্মদিনের আগেই বের করলাম ‘হাসান শাহরিয়ার সাংবাদিকতায় জীবন্ত কিংবদন্তি’ গ্রন্থটি। এর সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত মিজানুর রহমান শেলী। প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল শাহরিয়ার ভাইয়ের জন্মদিন পালন করা হত।

উৎস প্রকাশন থেকে হাসান শাহরিয়ারের ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। বিশ্বখ্যাত সংবাদ সাময়িকী ‘নিউজ উইক’ এর মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ হওয়ার প্রায় এক বছরের ব্যবধানে খ্যাতিমান সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার প্রামাণ্য দলিল নির্ভর গ্রন্থ ‘নিউজ উইক-এ বাংলাদেশ : মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় এবং তারপর’ নিয়ে হাজির হন পাঠকের সামনে। এটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালের দিকে। দীর্ঘ ত্রিশ বছর নিউজ উইকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ছিলেন হাসান শাহরিয়ার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন।

এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তিন দশকে নিউজ উইকে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিবেদন, সংবাদ, নিবন্ধ ও ব্যাখ্যামূলক সংবাদ। একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বহু দুর্লভ ছবি তাতে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের তিন দশকের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের রোমাঞ্চকর ইতিহাসের চিত্র পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। গ্রন্থে স্থান পাওয়া বিভিন্ন শিরোনামের নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে, ‘ভেঙে যাচ্ছে পাকিস্তান’, ‘পাকিস্তান : ফেরার কোনো উপায় নেই’, ‘পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ’, ‘রাজনীতির কবি’, ‘পাকিস্তান : শকুন ও বন্য কুকুর’, ‘টিক্কা খানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ’, ‘এশিয়ায় আরেকটি যুদ্ধ : দোষ কার?’, ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যাতনা’ ইত্যাদি। এসব নিবন্ধ সেসময় আন্তর্জাতিক মহলে বেশ সাড়া ফেলে।

মুক্তিযুদ্ধের পর সামরিক জান্তার ক্ষমতারোহণের পর প্রয়াত জেনারেল এরশাদের সাক্ষাৎকার, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক বিপর্যয় জলোচ্ছ্বাস নিয়ে প্রতিবেদন-নিবন্ধ স্থান পেয়েছে নিউজ উইকে।

হাসান শাহরিয়ার ১৯৯৩-৯৪ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। শনিবার (১০ এপ্রিল) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। ফুসফুসের জটিলতা ও জ্বর নিয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হাসপাতালে ভর্তি হন হাসান শাহরিয়ার।

১৯৪৪ সালের ২৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জে জন্ম নেওয়া হাসান শাহরিয়ার ষাটের দশকে দৈনিক ইত্তেফাক দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর পাকিস্তানের করাচিতে পড়াশোনা ও দৈনিক ডন পত্রিকায় কাজ করেন। সেখানে ইত্তেফাকের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। সত্তরের দশকের শুরুতে ঢাকায় এসে পুনরায় দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে অবসর নেন তিনি।

ইত্তেফাকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজ উইক, আরব নিউজ, ডেকান হেরাল্ডসহ বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেছেন হাসান শাহরিয়ার। কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিজেএ) আন্তর্জাতিক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পিএসডি/আরএইচ