প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা কিনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী টিকা পেতে ভারতের সেরামকে ৬০০ কোটি টাকা অগ্রিম দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যথাসময়ে টিকা না পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে- তা নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে নানা আশঙ্কা। তবে বিষয়টি নিয়ে ‘নেগেটিভ’ কিছু না ভাবার আহ্বান জানিয়েছেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা।

তিনি জানান, টাকার বিনিময়ে সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশকে একটা ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন পেলে তখন তা দ্রুতই বাংলাদেশে আসবে।

রোববার দুপুরে ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলেন তিনি। 

রাব্বুর রেজা বলেন, ‘আমরা যে ৬০০ কোটি টাকা দিচ্ছি, পুরোটাই একটা এগ্রিমেন্টের আওতায়। তারা আমাদের একটা ব্যাংক গ্যারান্টি দিচ্ছে। যদি কোনো কারণে তারা (সেরাম ইনস্টিটিউট) টিকা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পুরো টাকাই সরকার ফেরত নিয়ে আসতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনতা এবং স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে ওই টাকা অগ্রিম হিসেবে গচ্ছিত রাখা হবে। বিনিময়ে সেরাম ইনস্টিটিউট ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে। প্রথম চালানের টিকা বাংলাদেশে আসার পর সেরাম ইনস্টিটিউট ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে পারবে। টিকা সরবরাহ শুরু হলে বাকি টাকা দেওয়া হবে।’

সেরাম ইনস্টিটিউট যদি জুনের মধ্যে টিকা দিতে না পারে তাহলে বাংলাদেশ অগ্রিম দেওয়া টাকা ফেরত নেবে  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ভারতের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউট অগ্রিম টাকা হিসেবে এটা নেবে এবং বাকি টাকা টিকা সরবরাহ শুরু করার পর দেওয়া হবে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী তারা যদি আগামী জুনের মধ্যে টিকা দিতে না পারে তাহলে বাংলাদেশ অগ্রিম এই টাকা ফেরত নেবে।

এ বিষয়ে গতকাল (শনিবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম জানান, প্রথম চালানের ৫০ লাখ টিকার দাম বাবদ এই ৬০০ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে। আর চুক্তি অনুযায়ী তারা যদি আগামী জুনের মধ্যে টিকা দিতে না পারে তাহলে বাংলাদেশে অগ্রিম এই টাকা ফেরত নেবে।

তিনি বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা অনুসারে যুক্তরাজ্য ও ভারতে অনুমোদনের পর বাংলাদেশে টিকা নিয়ে আসতে এখন আর কোনো বাধা নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরও বলেন, দ্রুতই দেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিশেষ কমিটি এ টিকার অনুমোদন দিয়ে দেবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজ প্রস্তুত আছে।

এর আগে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত করোনার টিকা নিয়ে ৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই দিন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, সেরাম ইনস্টিটিউটের কারখানায় তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা পাবে বাংলাদেশ। এই টিকা দেড় কোটি মানুষকে দেওয়া সম্ভব হবে। প্রতি ডোজ টিকা সরকার কিনবে ৫ মার্কিন ডলার (৪২৫ টাকা) দিয়ে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস বাংলাদেশে ওই টিকার মূল সরবরাহকারী।

সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে করা চুক্তিতে বলা আছে, তারা ভারত ও বাংলাদেশের বাজারে একই সময়ে টিকা দেবে। সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত টিকা ভারতে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেলে তখন তা বাংলাদেশেও আসবে বলে আশা করা যায়।

টিকা কবে আসবে?
কবে নাগাদ টিকা আসতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে রাব্বুর রেজা বলেন, ‘ভ্যাকসিন আসাটা নির্ভর করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনের ওপর। যেহেতু ভারত ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে, এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায়। এর মধ্যেই যদি ওষুধ প্রশাসন অনুমতি দিয়ে দেয়, তাহলে খুব দ্রুতই আমরা টিকা পেয়ে যাবো বলে আশা করছি।’

জানুয়ারিতেই টিকা চলে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে গতকাল (শনিবার) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘আমরা এর আগে বলেছিলাম জানুয়ারির শেষের দিকে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভ্যাকসিন আসতে পারে। কিন্তু ভারতে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন অনুমোদন পাওয়ায় আমরা আশা করছি জানুয়ারিতেই ভ্যাকসিন পেয়ে যাব।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে ২০তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। ইউরোপের অনেক দেশ বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে আছে। আমেরিকা, ভারত পাকিস্তানের থেকেও আমরা এগিয়ে আছি। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন।’

করোনার উত্থান এবং বৈশ্বিক মহামারি
• গত বছরের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
• চীনে করোনায় প্রথম প্রাণহানি ঘটে ৯ জানুয়ারি।
• ১৩ জানুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় থাইল্যান্ডে।
• এই ভাইরাসে বিশ্বে প্রথম প্রাণহানি ঘটে ২ জানুয়ারি ফিলিপাইনে।
• ১১ মার্চ ‌‘করোনা মহামারি’ ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
• ৩ জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ১৩০।  

ফাইজারের টিকার জরুরি ব্যবহারের বৈধতা দিয়েছে ডব্লিউএইচও
ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনার টিকার জরুরি ব্যবহারের বৈধতা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গেল ৩১ ডিসেম্বর টিকাটির বৈধতার অনুমোদন দেয়। ডব্লিউএইচওর এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বব্যাপী টিকাটির আমদানি ও বণ্টনের বিষয়টি দ্রুত অনুমোদনের পথ প্রশস্ত হলো। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য গত ২ ডিসেম্বর ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। ৮ ডিসেম্বর দেশটিতে এই টিকার প্রয়োগ শুরু হয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বাহরাইন, সৌদি আরব, ইউরোপীয় দেশগুলোসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার অনুমোদন দিয়ে তার প্রয়োগ শুরু করে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি 
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আজকের (রোববার) তথ্যমতে, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ২৭ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭ হাজার ৬২৬ জনে।

একই সময়ে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৮৩৫ জন। এর মাধ্যমে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ১৬ হাজার ১৯ জনে দাঁড়িয়েছে। সুস্থ হয়েছেন আরও ৯৭৮ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫৯৮ জন।  

ভ্যাকসিনে রাতারাতি সমাধান নেই 
প্রাণঘাতী ও সংক্রামক ব্যাধি থেকে দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের জীবনরক্ষায় টিকা প্রদানে ভূমিকা রেখে আসা আন্তর্জাতিক জোট গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহ-নেতৃত্বে কোভ্যাক্স ৯টি ফার্মাসিউটিক্যাল ডেভলপারের কাছ থেকে টিকা সংগ্রহের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২০২১ সালের মধ্যে কোভ্যাক্স ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে চায়। কিন্তু কোনো ভ্যাকসিনের যদি একটি ডোজেও কাজ হয় (এখনও অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলোর দুটি ডোজ প্রয়োজন হয়) তবেও ২০০ কোটি ডোজ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না। 

টিআই/এনএফ