সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যুর পর আলোচনায় আসে লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড (এলএসডি) নামে নতুন ধরনের এক মাদক। এলএসডি সেবনের কারণে স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা হারিয়ে হাফিজুর আত্মহত্যা করতে পারেন বলে ধারণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের।

এদিকে বাংলাদেশে মাদক হিসেবে এলএসডি নতুন নাকি এর আগেও ব্যবহার ছিল এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও রমরমা ব্যবসা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার। আর সর্বনাশা এ মাদকের অধিকাংশ ক্রেতা বিক্রেতা হচ্ছেন দেশের নামীদামি বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ পর্যন্ত এলএসডি সেবন ও বিক্রির অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত এলএসডি বিক্রি ও সেবনের অভিযোগে আটজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপি। এদের মধ্যে গত বুধবার (২৬ মে) মহাখালী ডিওএইচএস থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪৬ স্ট্রিপ এলএসডি উদ্ধার করা হয়। শনিবার (২৯ মে) রাজধানীর খিলগাঁও এবং ভাটারা থেকে আরও ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের থেকে দুই হাজার মাইক্রোগ্রাম এলএসডি জব্দ করা হয়।

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রচলিত যেসব মাদক আছে এর মধ্যে এলএসডির দাম এখন পর্যন্ত সব থেকে বেশি। বর্তমানে এলএসডি মিশ্রিত ৩ পিস রঙিন প্রিন্টের ব্লট পেপারের দাম (আনুমানিক ওজন শূন্য দশমিক শূন্য এক গ্রাম) ৩ হাজার টাকা। ফলে ইয়াবা, গাঁজা কিংবা হেরোইন থেকে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতিকারক এই মাদক এখনও সব শ্রেণির মাদক সেবীদের হাতের নাগালের বাইরে। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে এলএসডির বাজার। দেশে এলএসডির ব্যবসা এবং সেবনের সঙ্গে জড়িত এমন ১৫টি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। এসব গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। 

যেভাবে দেশে গড়ে উঠছে এলএসডির বাজার

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত এক থেকে দেড় বছর আগে দেশি বিদেশি বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক প্রচারণার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এলএসডির প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে তারা কৌতূহলবশত অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডির সেবন প্রক্রিয়া ও কোথায় পাওয়া যায় সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে এলএসডি দেশে নিয়ে আসা ও সেবনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। পরে তারা বিদেশ থেকে এলএসডি দেশে নিয়ে এসে গ্রুপে আলোচনা করে কেনাবেচার বিষয়টি ঠিক করেন। এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া ১৫টি গ্রুপের সদস্য নিজেরাই এলএসডির ক্রেতা ও বিক্রেতা। এসব গ্রুপের বাইরে এলএসডির বিক্রির তেমন কোনো তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

কোথা থেকে আসছে এলএসডি

ডিবি সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণে এলএসডি দেশে এসেছে তা মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশীয় সেবনকারীরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ওইসব দেশের ব্যবসায়ীদের পে-পালে টাকা পাঠিয়ে এলএসডির অর্ডার করেন। কুরিয়ার ও ব্যাগেজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশে এলএসডি মাদক ঢুকছে। পরে দেশীয় সেবনকারীরা বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপের মাধ্যমে তা সরবরাহ করছেন।

এলএসডি সেবনের ভয়াবহতা

ডিবি ও ডিএমপির মতিঝিল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এলএসডি মাদক যদি কোনো মানুষ তার জিহ্বার নিচে দেয় তাহলে শরীরের এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সেবনকারীরা স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য জগতে চলে যায়। ইয়াবা, ফেনসিডিল কিংবা হেরোইনের থেকে এলএসডির নেশা আরও ভয়ানক। সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া হয়।

এ বিষয়ে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার মো. আব্দুল আহাদ বলেন, গ্রেফতার হওয়া তরুণরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তারা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত এক বছর ধরে এলএসডি সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত তারা। অনলাইনে এ ব্যবসার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল তারা। অনলাইন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা আকৃষ্ট হয়ে এলএসডি সেবন শুরু করে। তারা মূলত বিদেশ থেকে এলএসডি সংগ্রহ করে থাকে। রাজধানীতে ১৫টি গ্রুপ রয়েছে যারা এলএসডি বিক্রি করে আসছে। আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, এই গ্রুপগুলোর সদস্যরা সরাসরি ব্যবসা ও সেবনের সঙ্গে জড়িত। বাকিদের গ্রেফতার ও শনাক্তে অভিযান অব্যাহত আছে।

উল্লেখ, লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইড বা এলএসডি এক ধরনের তরল। ভারতের অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর এই মাদকটি আলোচনায় আসে। তার বিরুদ্ধে এই মাদক নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।

এলএসডি অত্যন্ত দামি একটি মাদক। সাধারণত ব্লটিং পেপারের ওপরে এই তরল মাদক ফেলে সেই কাগজ শুঁকে নেশা করে মাদকাসক্তরা। এলএসডি মাখা এক-একটি ছোট ছোট টুকরো ব্লটিং পেপারের দাম কয়েক হাজার টাকা।

১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের প্রথমদিকে এলএসডি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। তবে ওষুধটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে বলে একে নিষিদ্ধ করা হয়।

বিজ্ঞানীরা জানান, সাধারণত এলএসডি নেওয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার দেখা এসব দৃশ্য সবসময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে যায়। এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

তারা বলেন, এলএসডি নেওয়ার পর প্রকৃতি ও বাইরের জগতের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক অনুভূত হয় যাকে অনেকসময় ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। এই মাদকের প্রভাব কেটে গেলেও ওই রকম অনুভূতি থেকে যেতে পারে।

এলএসডি ব্যবহার করলে মানুষের স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে যায়। নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ কেউ মাতৃগর্ভের স্মৃতিও মনে করতে পারেন। তবে সে সব স্মৃতির ভার অধিকাংশ মানুষই সহ্য করতে পারেন না। ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অধিকাংশ মাদকগ্রহণকারীই স্মৃতির চূড়ান্ত স্তরে প্রবেশের আগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এলএসডি গ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই এমন দাবি করে থাকেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যালুসিনেশনই এসব অনুভূতির মূল কারণ।

এমএসি/এসকেডি