সংশোধিত ডিপিপিতেও গলদ
ভার্চুয়াল আদালতের প্রতীকী ছবি
৬৪ জেলায় দক্ষ, স্বচ্ছ ও ডিজিটাল বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চার বছর আগে উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার। এ লক্ষ্যে কয়েকটি নির্বাচিত জেলায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় ‘ই-জুডিশিয়ারি পাইলট’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ৩২৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একনেক সভায় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে আইন ও বিচার বিভাগকে সারাদেশে এ কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ‘ই-জুডিশিয়ারি’ প্রকল্পটি দুই হাজার ২০৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হয়।
কমিশন প্রকল্পটির ওপর ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করে। কিন্তু পিইসি সভায় একনেক সভার নির্দেশনা না মানাসহ অন্যান্য আরও কিছু বিষয় যুক্ত করে ডিপিপি সংশোধন করতে নির্দেশ দেয় পরিকল্পনা কমিশন। এরপর দুই বছর চলে গেলেও সংশোধিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়নি আইন ও বিচার বিভাগ।
বিজ্ঞাপন
দুই বছর পর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে আইন ও বিচার বিভাগ। দুই বছর পর প্রস্তাবের সঙ্গে প্রকল্পে আরও ৬০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ হাজার ৮৭৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটির ওপর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে পিইসি সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক বিভাগ। পিইসি সভায় কমিশন সংশোধিত ডিপিপির ব্যাপক ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করে প্রশ্ন তুলেছে।
ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প।
পিইসি সভার দুই বছর পর সংশোধিত ডিপিপি প্রস্তাব।
বিজ্ঞাপন
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, পরিকল্পনা বিভাগ থেকে জারি করা ‘সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি’ সংক্রান্ত পরিপত্রের ১.১৪ নং অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী পিইসি সভার কার্যবিরবণী প্রাপ্তির ২০ কার্যদিবসের মধ্যে পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করতে হবে। তা সম্ভব না হলে বিলম্বের যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে ৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে পুনর্গঠিত ডিপিপি প্রেরণ করতে হবে। উল্লেখিত সময়সীমার মধ্যে ডিপিপি প্রেরণ করা না হলে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী নয় বলে ধরে নেওয়া হবে। এমতাবস্থায়, প্রথম পিইসি সভার ২ বছর পর পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করার প্রেক্ষিতে পুনরায় পিইসি সভা আহ্বান করা হয়েছে। এই পরিপত্রের ধারাবাহিকতায় প্রকল্পটির ওপর নতুন করে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
যেসব খাতে গলদ
পিইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল বাস্তবসম্মতভাবে নির্ধারণ করতে হবে। প্রকল্পটির ওপর গত দুই বছর আগে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সভার ২ বছর পর পুনর্গঠিত ডিপিপি প্রেরণের কারণ সম্পর্কে মন্ত্রণালয়কে ব্যাখ্যা দিতে হবে। এর বইরে গত ২০১৯ সালের অক্টোবরে অর্থ বিভাগে অনুষ্ঠিত প্রকল্পের জনবল নির্ধারণ কমিটির সভায় প্রোগ্রামার (গ্রেড -৯), সহকারী প্রোগ্রামার (গ্রেড-৯), সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার (গ্রেড-৯) জনবলগুলো প্রেষণে পদায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু পুনর্গঠিত ডিপিপি উল্লেখিত জনবল পরামর্শক/আইটি সেবা হিসেবে উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে কমিশনকে বিস্তারিত জানাতে হবে।
৫টি যানবাহন কেনার জন্য ১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং ১টি যানবাহন ভাড়ার জন্য (৪৮ মাস) ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। কেনার জন্য প্রস্তাবিত যানবাহনের মধ্যে ১টির মূল্য ৯ কোটি, ১টি ৪ কোটি, ২ টির মূল্য ২ কোটি এবং ১টি মাইক্রোবাসের মূল্য ৬০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যানবাহনের সংখ্যা, প্রয়োজনীয়তা ও মূল্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে হবে।
বৈদেশিক স্টাডি/প্রশিক্ষণের জন্য ১০ কোটি, অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের জন্য ১১৭ কোটি, উচ্চতর প্রশিক্ষণের সাড়ে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। কাদেরকে, কত মেয়াদে, কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
ডিপিপি সংশোধনের নামে মাঝখানে দুই বছর দেরি হওয়া মানে বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশ থেকে পিছিয়ে গেল। এতো দেরিতে ডিপিপি সংশোধন করে পাঠালেও ভুল-ত্রুটি কমেনি।
পরামর্শক সেবা (টেকনিক্যাল/আইনি) খাতে মোট ১২৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা, মেয়াদ ও বরাদ্দ প্রস্তাবের ভিত্তি বোধগম্য নয়। অন্যান্য মনোহারী (২৫ লাখ টাকা), সাধারণ সরবরাহ (২৫ লাখ টাকা), সাধারণ থোক বরাদ্দ (২০ লাখ টাকা), অপ্রত্যাশিত ব্যয় (২০ লাখ টাকা) খাতসমূহ প্রায় একই ধরনের হলেও প্রতিটি খাতে পৃথক বরাদ্দ চাহিদার প্রয়োজনীয়তা কী?
কম্পিউটার মেরামত খাতে ১ কোটি টাকা, দুই হাজার ল্যাপটপ কেনার জন্য ২০ কোটি টাকা, চার হাজার ডেস্কটপ কেনার জন্য ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের সংখ্যা নির্ধারণের ভিত্তি নিয়ে সভায় আলোচনা করতে হবে।
পিআইইউ, সুপ্রীম কোর্ট, অধস্তন আদালতের অফিস যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার ও অন্যন্য সরঞ্জামাদির জন্য ৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে যা অত্যাধিক বলে প্রতীয়মান হয়। আউটসোর্সিং জনবলের বেতন-ভাতা নির্ধারণের ভিত্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে হবে। ক্রয় পরিকল্পনা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে প্রস্তাব করতে হবে।
উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, বিচার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনিক এবং বিচার কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করা, ই-আদালতকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা এবং আইসিটি’র জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা বিচারক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীদর সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ইত্যাদি কাজ করা হবে।
আইন ও বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সীমিত সংখ্যক বিচারক, বিচার ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারী, গতানুগতিক পদ্ধতির বিচার কার্যক্রম ইত্যাদি কারণে যথাসময়ে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন ও রায় দেওয়া সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ‘কেইস ব্যাকলগ’ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বিচার কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার জন্য এবং বিচার প্রাপ্তিতে জনগণের প্রবেশাধিকার সহজলভ্য করতে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে ডিজটালাইজেশন করা জরুরি।
এ বিষয়ে আর্থ-সামাজিক বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশের প্রত্যেক সেক্টরই ডিজিটাল হচ্ছে। সে হিসেবে দেশের বিচার কার্যক্রম এখনও সেভাবে ডিজিটালে প্রবেশ করতে পারেনি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিচার কার্যক্রমও অনলাইনে চালু করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই বছর আগে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি এখন আবার নতুন করে প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ডিপিপি সংশোধনের নামে মাঝখানে দুই বছর দেরি হওয়া মানে বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশ থেকে পিছিয়ে গেল। এতো দেরিতে ডিপিপি সংশোধন করে পাঠালেও ভুলত্রুটি কমেনি। পিইসি সভার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্পটির ডিপিপি আবারও সংশোধনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
এসআর/এইচকে