‘নীরব এলাকা ঘোষিত সচিবালয়ের চারপাশে তীব্র শব্দ দূষণ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফল প্রকাশ

তীব্রতার ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ লক্ষ্য করা গেছে পল্টন বাসস্ট্যান্ডে এবং সময়ের ব্যাপ্তিতে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ কদম ফোয়ারা মোড়ে। গত ১৪ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট নয়দিনে রাজধানীর ১২টি স্থানের মধ্যে সর্বোচ্চ শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ১২০ ডেসিবলের উপরে।

এসব এলাকার মধ্যে পল্টন বাসস্ট্যান্ডে (১২৯.২ ডেসিবল) সবচেয়ে বেশি শব্দের মাত্রা পাওয়া যায়।

শনিবার (৯ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের সাগর রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় পরিচালিত ‘নীরব এলাকা ঘোষিত সচিবালয়ের চারপাশে তীব্র শব্দ দূষণ’ শীর্ষক প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফলে এ তথ্য পাওয়া যায়। এসব তথ্য তুলে ধরেন বাপার যুগ্ম সম্পাদক এবং স্ট্যামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।

সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট নয়দিনে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ১০ সদস্যের একটি গবেষণা দল সচিবালয়ের আশেপাশের ১২টি স্থানে নীরব এলাকা ঘোষণার আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে। এ সময় নির্ধারিত এলাকাগুলো থেকে দিনব্যাপী ১ হাজার ৮০০ সংখ্যক উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছিলো। সে হিসাবে ১২টি স্থানে সকাল-দুপুর-বিকালে সর্বমোট প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪০০ সংখ্যক উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। জরিপ কাজের উদ্দেশ্য ছিল ২০১৯ সালে ডিসেম্বর মাসে নীরব এলাকা ঘোষণা করার আগে এবং পরে শব্দ দূষণের যে পরিবর্তন হয়েছিল তার সঙ্গে ২০২০ সালে ডিসেম্বর মাসের শব্দ দূষণের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি-না তার পার্থক্য বের করা।

তিনি বলেন, পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে যানবাহন চলাচলে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণের কারণে সময়ের ব্যাপ্তিতে শব্দ দূষণ কিছুটা কমলেও তীব্রতার দিক থেকে তা বেড়েছে। অর্থাৎ, সংগৃহীত উপাত্তের গড় হিসাবে শব্দের সর্বোচ্চ মান পাওয়া গিয়েছে কদম ফোয়ারায়, যা ১১৮.৭ ডেসিবল এবং সবার চেয়ে কম শব্দ রয়েছে সচিবালয়ের পশ্চিম দিকে (মসজিদ) ৯৯.৫ ডেসিবল। শব্দের সর্বোচ্চ মানের দিক থেকে ২০১৯ এর চেয়ে ২০২০ সালে ৭.৮ শতাংশ দূষণ বেড়েছে। তবে শব্দের সর্বোচ্চ মানের ভিত্তিতে দূষণের স্থানভেদে ক্রম পরিবর্তন হয়েছে। দিনের ব্যবধানে, সকালের তুলনায় দুপুর এবং বিকালের সময়ে গড় শব্দের সর্বোচ্চ মান কিছু বেশি ছিল। ১২টি স্থানের প্রতিটিতে দিনের বেলায় ১০০ ভাগ সময় নীরব এলাকার জন্য প্রযোজ্য মানমাত্রার (৫০ ডেসিবল) চেয়ে প্রায় ২.১ গুন বেশি মাত্রার শব্দ ছিল। ২০২০ সালে সামগ্রিকভাবে ১২টি স্থানে ৮৮.৪ শতাংশ সময় ৭০ ডেসিবল (তীব্রতর) এর বেশি শব্দের মাত্রা ছিল যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩.৫ শতাংশ কম। যেহেতু করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় ১০ শতাংশ যানবাহন কম চলেছে (স্কুল কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায়)। সেখানে মাত্র ৩.৫ শতাংশ শব্দের মাত্রা কমলেও প্রকৃত হিসাবে শব্দ দূষণ না কমে বরং বেড়েছে। জরিপ পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে হর্ন গণনার ফলাফল অনুযায়ী ‘জিরো পয়েন্ট’ এলাকায় সবচেয়ে বেশি হর্ন গণনা করা হয় যেখানে ১০ মিনিটে ৩৩২টি হর্ন বাজাতে দেখা যায়, যার মধ্যে ৭০টি হাইড্রোলিক হর্ন এবং ২৬২টি সাধারণ হর্ন। ২০০ ট্রাফিক পুলিশদের শ্রবণ স্বাস্থ্যের উপর প্রশ্নপত্র জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দায়িত্বরত ৯.৫ ভাগ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি হ্রাস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮.৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানান, অন্যরা উচ্চস্বরে কথা না বললে তাদের শুনতে কষ্ট হয়, ১৩.৭ ভাগ ট্রাফিক পুলিশের সাধারণভাবে মোবাইলে কথা শুনতে অসুবিধা বোধ করেন।

পল্টন বাসস্ট্যান্ডে ১২৯.২ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে

সচিবালয়ের ভিতর ও চারপাশে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, সচিবালয়ের দেওয়ালে সাউন্ড প্রুফ প্লাস্টার বোর্ড বসানো যেতে পারে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে রাস্তায় সাইরেন বাজানোসহ ভিআইপি প্রটোকল না দিতে অনুরোধ করেন।

বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শব্দ দূষণ একটি সামাজিক ব্যাধি এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে, সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শব্দ দূষণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়াও হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার ও এর আমদানি নিষিদ্ধ করণের আইনটি দ্রুত কার্যকর করার জন্য তিনি সরকারকে অনুরোধ জানান।

শব্দ দূষণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য এ সময় সরকারের কাছে ১৯টি সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে- সচিবালয়ের ভিতর ও চারপাশে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগানো; সচিবালয়ের দেওয়ালে সাউন্ড প্রুফ প্লাস্টার বোর্ড বসানো; বিধিমালা সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করা; হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ করা, হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি ও চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান করা; নীরব এলাকা ঘোষণার আগে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং চালকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা; অনুমতি ব্যতীত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ করা এবং মাইকের শব্দ সীমিত করা; ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য উচ্চতর শব্দের পরিবেশ এড়ানো; ট্রাফিক পুলিশদের কানের সুরক্ষা সরঞ্জামগুলি (পিপিই) যেমন কান এবং শ্রুতি সুরক্ষার জন্য কানের প্লেগ বা ইয়ারম্যাফ ব্যবহার করা; নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা; সড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা; আবাসিক এলাকা সমূহকে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তরিত না করা; পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রশাসনিক দপ্তরের সমন্বয় সাধন করা; শব্দের মাত্রা অনুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া; গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা; পৃথক বাইসাইকেল লাইন চালু করা, জেনারেটর এবং সকল প্রকার শব্দ সৃষ্টি যন্ত্রপাতির মান মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া; শব্দের মাত্রা হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রদান না করা; কমিউনিটি ভিত্তিক কমিটি করে শব্দ দূষণ সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের বিষয়ে তদারকি দায়িত্ব প্রদান করা এবং শব্দ দূষণের ক্ষতি, প্রতিকার ও বিদ্যমান আইন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য স্থপতি অধ্যাপক মুহাম্মাদ আলী নকী, বাপার যুগ্ম-সম্পাদক আলমগীর কবির প্রমুখ।

এইচএন/এমএইচএস