বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন

বিদায়ী ২০২০ সালে দেশে ৪ হাজার ৮৯১ সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৮ হাজার ৬০০ জন। সড়ক, রেল, নৌ-পথে সর্বমোট ৫ হাজার ৩৯৭টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩১৭ জন নিহত এবং ৯ হাজার ২১ জন আহত হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

শনিবার (৯ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ প্রতিবেদন তুলে ধরেন। 

দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদায়ী বছরে আঞ্চলিক মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনা ৬.৭৮ শতাংশ বাড়লেও জাতীয় মহাসড়কে ৩.৪৫ শতাংশ, রেলক্রসিংয়ে ০.১৬ শতাংশ, ফিডার রোডে ২.১৯ শতাংশ কমেছে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে হবে। আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী মহাসড়কের উভয় পাশে ১০ মিটার খালি রাখার বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে দুর্ঘটনা বাড়বেই।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর রেলপথে ৩২৩ দুর্ঘটনায় ৩১৮ জন নিহত হন। নৌ-পথে ১৮৩টি দুর্ঘটনায় ৩১৩ জন নিহত, ৩৪২ জন আহত এবং ৩৭১ জন নিখোঁজ হন।

ওই সময়ে সংগঠিত দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৬ হাজার ৭৩৬ যানবাহনের পরিচয় মিলেছে, যার ১৩.১২ শতাংশ বাস, ২৮.৩৯ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ৫.৪১ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ৮.৫২ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ২৪.৮০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ৯.০৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ১০.৬৪ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।

সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৫২.৯৬ শতাংশ গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২২.০৬ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৭.০৮ শতাংশ খাদে পড়ে, ৬.৭১ শতাংশ বিবিধ কারণে, ০.৩৪ শতাংশ চাকায় ওড়না পেছিয়ে এবং ০.৮১ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সংগঠিত যানবাহনের ৩.৭৬ শতাংশ মোটরসাইকেলে, ৩.৩২ শতাংশ নসিমন-মাহিন্দ্রা-লেগুনায়, ১.০৪ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইকে, ০.১৯ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাসে দুর্ঘটনা বাড়লেও ৫.৮৭ শতাংশ বাস, ১.৪২ শতাংশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-লরি, ০.৮৩ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনা কমেছে।

পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে,  ২০১৯ সালের তুলনায় বিদায়ী ২০২০ সালে পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা ৩.৩৯ শতাংশ, বেপরোয়া গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ০.৯৯ শতাংশ ও ট্রেন যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ০.১৬ শতাংশ কমলেও মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ৩.৭ শতাংশ বেড়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৮.৯৩ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৪.৬৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৯.১১ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪.৩৭ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২.০৬ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ০.৮১ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।

যেসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হয়
১. বেপরোয়া গতি; ২. বিপদজনক অভারটেকিং; ৩. রাস্তা-ঘাটের ত্রুটি; ৪. ফিটনেসবিহীন যানবাহন; ৫. যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা; ৬. চালকের অদক্ষতা; ৭. চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার; ৮. মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো; ৯. রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা; ১০. রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা; ১১. ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ; ১২. ছোট যানবাহন বৃদ্ধি; ১৩. সড়কে চাঁদাবাজি; ১৪. রাস্তার পাশে হাট-বাজার এবং ১৫. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১২ সুপারিশ
১. সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা; ২. আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা; ৩. সড়ক নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশ বাস্তবায়ন উদ্যোগ নেয়া; ৪. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী মহাসড়কের উভয় পাশে ১০ মিটার খালি রাখার বিধান বাস্তবায়ন করা; ৫. দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রাক্রসিং অঙ্কন করা।
৬. গণপরিবহন চালকদের প্রফেশনাল ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; ৭. সড়ক পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা; 

৮. গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে আধুনিকায়ন করা; ৯. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনপূর্বক হতাহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; ১০. দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেয়া; ১১. ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা এবং ১২. গণপরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য দেশের সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন গণপরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।

পিএসডি/এসএম