আদর্শ মৎস্য গ্রাম নড়িয়ার হালইসার
আদর্শ মৎস্য গ্রাম হালইসারের প্রবেশপথ
আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, সাদামাটা ঘরবাড়ি আর সন্ধ্যে হতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার- এসবই এক সময় চিরায়ত গ্রাম-বাংলার পরিচয় বহন করত। আবার জেলেদের গ্রাম বলতে নদীতীরে কুটিরে বসতি গড়া, নানা অভাব অনটনে জর্জরিত মৎস্যজীবীদের বোঝাত।
একযুগ আগেও শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার ইউনিয়নের হালইসার জেলে গ্রামটি এমনই ছিল। কিন্তু এখন সেই জেলেগ্রামে গেলে আগের সেই চিত্র আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেননা, বিগত কয়েক বছরে সরকারি–বেসরকারি সংস্থার নানামুখী উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের ফলে জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন হয়েছে অনেক।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি সরকার জেলে অধ্যুষিত এ গ্রামটিকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মৎস্য অধিদফতর ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে গ্রামটিতে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। শহুরে জীবনের প্রায় সব সুবিধাই এখন এ গ্রামে মিলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) অর্থায়নে পরিচালিত মৎস্য অধিদফতরের সাথে যৌথভাবে বাস্তবায়িত ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের ইকোফিশ-২ কার্যক্রম এই আদর্শ মৎস্য গ্রাম বাস্তবায়নে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের গৃহীত কার্যক্রমের আওতায় এ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের বিশেষ কর্মসূচি ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ বাস্তবায়নে মৎস্য অধিদফতরের ‘মৎস্য গ্রাম’ কার্যক্রম মূলত সমৃদ্ধ গ্রাম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ইউএসএআইডির ইকোফিশ-২ কার্যক্রমের কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট মো. আসাদুজ্জামান জানান, এ কার্যক্রমের আওতায় হালইসার গ্রামে অবকাঠামো উন্নয়ন, মৎস্য চাষ, কৃষিনির্ভর শিল্প, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষির বহুমুখীকরণ ও বাজার ব্যবস্থাপনাসহ নানারকম সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও জীবনমান উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মৎস্য অধিদফতর গ্রামটিতে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, গ্রামের সকল পুকুরে বিজ্ঞানসম্মত মাছ চাষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ, মাছ চাষীদের দল গঠন, প্রশিক্ষণ ও প্যাকেজভিত্তিক পুকুরে মাছ চাষ প্রদর্শনী, জেলেদের দল গঠন, প্রশিক্ষণ, বিকল্প কর্মসংস্থান ও ঋণ সহায়তা প্রদান, পোনা অবমুক্তকরণ, জলাশয় সংস্কার ও মাছের অভয়াশ্রম স্থাপন এবং কমিউনিটি সঞ্চয় দল গঠনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন।
মো. আসাদুজ্জামান জানান, এছাড়া গ্রাম দুটিতে সরকারের অন্যান্য দফতরের সহায়তায় আরও কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেগুলো হলো- গভীর নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপন, যানবাহন চলাচল উপযোগী রাস্তা নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, সুফলভোগীদের হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গ্রামের অধিবাসীদের সন্তানদের শতভাগ শিক্ষা কর্মসূচি নিশ্চিতকরণ ও অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ।
ইউএসএআইডির তথ্যানুসারে, ইকোফিশ-২ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৫ সাল থেকে এ গ্রামের জেলেদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, বিকল্প আয় বর্ধনমূলক কাজে যুক্তকরণ, সামাজিক ও পরিবেশগত সহনশীলতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এ সবের মধ্যে ছিল জেলে পরিবারে হাঁস–মুরগি, ছাগল ও গরু, সবজি বীজ প্রদান, পুকুর সংস্কার ও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ, নারীদের জন্য সঞ্চয় ও ঋণ সুবিধা। বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রায় ৬০ জন নারীকে লেখাপড়া শেখানো হয়েছে যাতে তারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেন এবং সাধারণ হিসাব করতে পারেন।
গ্রামবাসীরা জানান, এছাড়াও মৎস্য ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে জেলেদের প্রশিক্ষণ, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ, বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। জেলেদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কমিউনিটি ফিশগার্ড। যারা মৎস্য সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রম, জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ, অভয়াশ্রম পাহারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। তাদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার জন্য পরিচয়পত্র, ট্রাউজার, গামছা, ছাতা, অ্যাপ্রোন, জুতা, টর্চলাইট প্রদান করা হয়েছে।
হালইসারের বাসিন্দা প্রবীণ মৎস্যজীবী দাদন সরদার বলেন, “ইকোফিশ প্রকল্পের পক্ষ থেকে আমাদের গ্রামে জেলদের মাঝে নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও বিকল্প কর্ম সংস্থানের জন্য যেসব সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে তাতে আমরা খুব উপকৃত হয়েছি। আদর্শ এ মৎস্য গ্রামের বাসিন্দা হতে পেরে আমরা গর্বিত।”
এক সময়ের সাধারণ জেলে পল্লী হালইসার এখন আদর্শ গ্রাম। এ গ্রামের সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এবং অর্জিত সাফল্য অন্যান্য গ্রামের জন্য অনুকরণীয় হবে বলে মনে করেন নড়িয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক।
এইচকে