২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ বায়ু মানমাত্রা (অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা ২.৫) প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ৬৫ মাইক্রো গ্রাম নির্ধারণ করা হয়েছে। যা বিরাজ থাকলে ওই বায়ুকে নির্মল বায়ু হিসেবে ধরা হয়। সেই হিসেবে সদ্য বিদায়ী জুলাই মাসে রাজধানীবাসী পেয়েছে নির্মল বায়ু। কারণ, জুলাই মাসে ঢাকায় বায়ুর মানমাত্রা ছিল গড়ে ৩১.৩১ মাইক্রো গ্রাম।

বেশ কয়েক বছর ধরেই দূষিত বাতাসের শহর হিসেবে ঢাকা ছিল প্রথম সারিতে। তবে ধীরে ধীরে সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বাংলাদেশের রাজধানী শহর। বর্তমানে ঢাকা দূষিত নগরীর তালিকায় ২৩তম স্থানে আছে। গত ৩০ জুলাই এই চিত্র দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুর মান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এ। 

এদিকে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিবেদন অনুসারে এ বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪ মাসের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে নির্মল বায়ু ছিল জুলাই মাসে। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণার উপস্থিতি ছিল গড়ে ৮০.৭৫ মাইক্রো গ্রাম, মে মাসে ৮০.৯৬ মাইক্রো গ্রাম, জুন মাসে ৫২.৫০ মাইক্রো গ্রাম ও জুলাই মাসে ৩১.৩১ মাইক্রো গ্রাম। কয়েকধাপে লকডাউনের সাথে সাথে জুন ও জুলাই মাসে ঢাকা শহরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা বায়ু দূষণরোধে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। 

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত বৃষ্টিপাতের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে এপ্রিল মাসে মোট বৃষ্টিপাত ছিল ৪৬.২১৬ মিলিমিটার, মে মাসে ৩৫৪.৮৪ মিলিমিটার, জুন মাসে ৬৮৫.৪২২ মিলিমিটার এবং জুলাই মাসে ৩৬৫.৯৩১ মিলিমিটার। যার ফলে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমানের উন্নতি হয়। 

ক্যাপসের অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ঈদুল আজহার দিন (২১ জুলাই) ঢাকা শহরে টানা প্রায় ১১ ঘণ্টাসহ (সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা) মোট ১৩ ঘণ্টা বায়ুমান সূচক ৫০ এর নিচে ছিল। যেখানে ২০২০ সালে ঈদুল আজহার দিন এমন ভালো বায়ুমান ছিল মাত্র ৪ ঘণ্টা। গত বছরের ঈদের দিনের তুলনায় এবার ঢাকার বায়ু প্রায় তিন গুণ বেশি সময় খুবই ভালো ছিল। ঈদের পরের দুই দিন ঢাকার বায়ুর মানের সূচক গড়ে ৫০ এর নিচে ছিল, যা খুবই ভালো হিসেবে ধরা হয়- যাকে নির্মল বায়ু বলা যায়। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে এই সূচক ২০০-র বেশি থাকে। কখনও কখনও তা ৩০০-র কাছাকাছি চলে যায়।

ক্যাপস ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঈদ ঘিরে মোট ৫০ দিন ঢাকায় বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে। সেখানে দেখা যায়, ৫০ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৬ দিন বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ঈদুল ফিতরের পরের ২ দিন বায়ুমান সূচক ছিল ৪২ ও ৩৬; ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের পরদিন বায়ুমান সূচক ছিল ৩৭; ২০১৯ সালে ঈদুল আজহার পরের দুই দিন বায়ুমান সূচক ছিল ৪৯ ও ২২ এবং ২০২১ সালে ঈদুল আজহার এক দিন পর বায়ুমান সূচক ৪৪ ছিল। যেখানে বায়ুমান সূচক ০-৫০ ভালো, ৫১-১০০ মোটামুটি, ১০১-১৫০ সতর্কতামূলক, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে ধরা হয়। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সময়গুলোতে রাজধানীতে গাড়িতে চলাচল কম থাকা; কলকারখানা বন্ধ থাকা; নির্মাণকাজ বা উন্নয়নমূলক কাজ না হওয়ায় বায়ু দূষণ তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে। বিধিনিষেধের এই সময় বড় বড় প্রকল্পগুলো স্বাভাবিকের থেকে একটু মন্থর গতিতে চলমান থাকলেও, প্রকল্প সংলগ্ন এলাকা দিয়ে চলাচল করা মানুষ ও গাড়ির আনাগোনা ছিল কম। ফলে উৎস হতে দূষক ছড়িয়ে পড়াও কম ছিল। এর ফলে বায়ুমানের উন্নতি হয়েছে। বায়ু দূষণের তৃতীয় প্রধান উৎস ফিটনেসবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ, পুরানো যানবাহন এবং তীব্র যানজট। বর্তমান ঢাকার ছবি দেখলেই বোঝা যায় রাস্তায় যানবাহনের পরিমাণ কম। ফলে দূষণের পরিমাণ অনেকাংশে কম। গবেষণায় শুধু ঢাকা শহরের ওপর তথ্য প্রদান করা হলেও দেশের অন্যান্য স্থানের বায়ুর মানও ভালো হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।

ঢাকার নির্মল বায়ু ধরে রাখতে কী কী প্রয়োজন? এমন এক প্রশ্নের জবাবে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘২১ জুলাইয়ের পর থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বায়ুমান সূচক অত্যন্ত ভালো ছিল। উপমহাদেশের ইতিহাসে এত নির্মল বায়ু কখনও ছিল না। এটি একটি ম্যাজিক্যাল সপ্তাহ গেল।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘নির্মল বায়ু ধরে রাখতে সর্বপ্রথম আমাদের যা করতে হবে তা হলো- নির্মাণকাজগুলোতে পরিবেশবিধি মানতে হবে এবং সংস্কারকাজে সমন্বয় আনতে হবে। নির্মাণ এলাকা থেকে যেন দূষক ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। ঢাকার চারপাশে অবস্থিত ইটের ভাটায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও ফিটনেসবিহীন গাড়ির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘করোনা অতিমারিতে মানুষের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে অনিচ্ছা দেখাচ্ছে। প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধির ফলে কমে গিয়েছে গাড়ির অবাধ চলাচল। সব কিছু চলছে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে। গবেষণায় শুধু ঢাকা শহরের ওপর তথ্য প্রদান করা হলেও বায়ু একটি বৈশ্বিক বিষয়। যার গতিবিধির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই। করোনা সংক্রমণ রোধে দফায় দফায় লকডাউনে মানবসৃষ্ট দূষণ কমেছে। প্রকৃতি সুযোগ ও সময় পেয়েছে বায়ু দূষণ প্রশমনের। অর্থাৎ, ঢাকায় বায়ুদূষণ বাড়ার যে কারণ তার মাত্রা কমেছে। একথা কারও অজানা নয় যে ঢাকার জনসংখ্যা তার ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি। কর্ম না থাকায় অনেক মানুষ ঢাকায় ফিরছে না, নিজ গ্রামে করে নিচ্ছে জীবিকা। অর্থাৎ, ঢাকায় কার্যক্রম বিকেন্দ্রীভূত হয়েছে; যা বায়ু দূষণে রোধেও ভূমিকা রাখছে।’

এমএইচএন/এইচকে