• অনেক দেশে স্বীকৃতি থাকলেও বাংলাদেশে অবৈধ বিটকয়েন
• বৈধতা না থাকলেও বাংলাদেশে থেমে নেই এর ব্যবহার 
• বিটকয়েনের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা নেই 
• বিটকয়েনে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা 
• ভার্চ্যুয়াল মুদ্রানির্ভর ভবিষ্যৎ আর্থিক ব্যবস্থার ইঙ্গিত রয়েছে বিটকয়েনে 
• বাংলাদেশ, মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো প্রভৃতি দেশে বিটকয়েন এখনও নিষিদ্ধ

দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েন বাংলাদেশে অবৈধ। বিটকয়েনে লেনদেন না করার নির্দেশনাও রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যদিও এর ব্যবহার থেমে নেই। বাংলাদেশে এর আইনি কোনো ভিত্তি না থাকলেও এ ক্রিপটোকারেন্সি ব্যবহারে প্রতারণা ও অবৈধ লেনদেন এবং বিদেশে মুদ্রা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। নেপথ্যে সহযোগী হিসেবে উঠে এসেছে সাইদ নামে এক পাকিস্তানি নাগরিকের নাম।

গতকাল (বুধবার) বিশেষ অভিযান চালিয়ে মো. রায়হান হোসেন (২৯) নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। র্যাব বলছে, বাংলাদেশে বিটকয়েন ক্রয়-বিক্রয় ও প্রতারণার মূলহোতা এই রায়হান। গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার সফিপুর দক্ষিণপাড়া থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে ১৯টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ২২টি সিমকার্ড, নগদ ২৫ মার্কিন ডলার, একটি কম্পিউটার, তিনটি মোবাইল ফোন, একটি অডি গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের সনদপত্র, তিনটি ভুয়া চালান বই, একটি ট্রেড লাইসেন্স, একটি টিআইএন সার্টিফিকেট, একটি রেকর্ডিং মাইক্রোফোন, একটি ক্যামেরা, একটি রাউটার, একটি হেডফোন, একটি মডেম, বিভিন্ন ব্যাংকের চারটি চেক বই জব্দ করা হয়।

র‌্যাবের দাবি, রায়হান বিটকয়েন ক্রয়-বিক্রয়সহ মানি লন্ডারিং, ক্রেডিট কার্ড হ্যাকিংয়ের মূলহোতা। এসবের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি কিনেছেন বিলাসবহুল গাড়িও।

এ ব্যাপারে র‌্যাব-১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর গাজী আশিকুর রহমান জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব জানতে পারে যে, কতিপয় ব্যক্তি বাংলাদেশে অনলাইনে নিষিদ্ধ ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েন ক্রয় বিক্রয় করে আসছেন এবং এর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। 

এরই ধারাহিকতায় র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল অনলাইনে নজরদারি বৃদ্ধি করে বিটকয়েন ক্রয়-বিক্রয় ও প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী কতিপয় চক্রকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তদন্ত ও নজরদারিতে বিটকয়েন ক্রয়-বিক্রয়ের মূল হোতা হিসেবে রায়হানের নাম উঠে আসে।

কী এই বিটকয়েন?
প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থায় যেমন একটি দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জড়িত থাকে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা হয় না। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনলাইনে দুজন ব্যবহারকারীর মধ্যে সরাসরি (পিয়ার-টু-পিয়ার) আদান-প্রদান হয়। লেনদেনের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি নামের পদ্ধতি। নিজের পরিচয় প্রকাশ না করেই এতে লেনদেন করা যায়। অন্যদিকে লেনদেনের ব্যয় খুব কম। অনলাইনে ডলার-পাউন্ড-ইউরোর পাশাপাশি কেনাকাটা করা গেলেও অনেক দেশই বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সগুলো থেকে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রানির্ভর ভবিষ্যৎ আর্থিক ব্যবস্থার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

কিছু তথ্য 
• চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বিটকয়েনের মূল্য ওঠানামা করে, কারণ এর সরবরাহ সীমিত 
• বিটকয়েনের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা নেই। অর্থাত এটিকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। 
• কে বিটকয়েন কিনতে পারবে আর কে পারবে না তা নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই 
• প্রত্যেক বিটকয়েন ব্যবহারকারীর একটি আলাদা চাবি থাকে; এটা অনেকটা পাসওয়ার্ড এবং লেনদেনের অনুমোদন দেওয়ার মতো 
• বিশেষ ডিজিটাল ওয়ালেটে বিটকয়েন জমা রাখা যায়, অনলাইন এক্সচেঞ্জে বা অফলাইনেও রাখা যায় 
• বিটকয়েন তৈরি হয় এমন একটি প্রক্রিয়া থেকে যাকে বলা হয় মাইনিং
• কিছু অনলাইন এক্সচেঞ্জ রয়েছে যেখানে প্রচলিত মুদ্রার বিনিময়ে  বিটকয়েন কিনতে পাওয়া যায়
• বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটকয়েনের বাজার একটি অস্থির বাজার 
সূত্র : বিবিসি। 

গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রায়হান জানিয়েছেন, ২০১১ সাল থেকে তিনি ওয়েব ডেভলপিং, গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের কাজ করা ছাড়াও ইউটিউব চ্যানেল চালিয়ে আসছেন। ২০২০ সালের জুন মাস থেকে সাইদ নামে এক পাকিস্তানি নাগরিকের সহায়তায় বাংলাদেশে অবৈধ ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েনের মাধ্যমে প্রতারণা শুরু করেন।

র‌্যাব বলছে, রায়হান জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানিয়েছেন, বিটকয়েনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান, নাইজেরিয়া এবং রাশিয়ান স্মাগলার, ক্রেডিট কার্ড হ্যাকার ও অবৈধ বিটকয়েনের মাধ্যমে অবৈধ পাচারকারীদের সাথে যোগসাজসে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা ও জালিয়াতিও করেছেন তিনি।

রায়হান ক্রেডিট কার্ড হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিটকয়েন কিনতেন। স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করে নামে-বেনামে দেশি এবং বিদেশি অনলাইন ব্যাংক হিসাব তদারকি করে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজার ইউএস ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও জানিয়েছে র‌্যাব। 

৫/৬ মাস আগে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা দিয়ে একটি অডি গাড়িও কেনেন রায়হান। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

বাংলাদেশে বিটকয়েনের কী অবস্থা 
বিট কয়েনের বৈধতা পেতে ২০১৪ সালে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এদেশের আগ্রহী কিছু ফ্রিল্যান্সার। এর অংশ হিসেবে ওই সময় তারা বেশ কিছু ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিটকয়েন কোনো দেশের ইস্যুকৃত বৈধ মুদ্রা নয়। বিটকয়েন বা বিট কয়েনের মতো কিংবা অন্য কোনো কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন বহির্ভূত এসব লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।  

জেইউ/এনএফ